‘আমাগো চোখির দ্যাহা সার্থক’

পিকআপ ভ্যানের ওপর সুসজ্জিত নৌকা নিয়ে সমাবেশে এসেছেন তাঁরা। গতকাল শরীয়তপুরের নাওডোবা এলাকায়
ছবি: আলীমুজ্জামান

‘জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো খুশি হইছি।’ কথাটি ৭৬ বছর বয়সী আবদুল রশীদ আকনের, মাদারীপুরের শিবচর যাঁর বাড়ি। গতকাল শনিবার শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় যোগ দেন তিনি। বললেন, ‘একাত্তর সালে স্বাধীনতা ঘোষণার সময় যে আনন্দ পেয়েছি, আজ পদ্মা সেতু উদ্বোধনে ঠিক সেই দিনের মতো আনন্দ পেয়েছি।’

আবদুল রশীদের বাড়ি জনসভাস্থলের কাছাকাছি হলেও কেলাফত হাওলাদার খুলনার রূপসাঘাটের বাসিন্দা। পেশায় মৎস্য ব্যবসায়ী ৬৫ বছর বয়সী কেলাফতের এত দূর আসা যেন সার্থক হলো, ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখতি পারিছি, এইডেই মেলা কতা। আমাগো চোখির দ্যাহা সার্থক।’

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা শ্রেণি–পেশার হাজারো মানুষ বাংলাবাজার ঘাটে প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় যোগ দেন।

পুরুষের পাশাপাশি দলে দলে যোগ দেন নারীরাও। নারীদের জন্য সভাস্থলে রাখা হয় পৃথক বসার ব্যবস্থা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থেকে আসা রাবেয়া বেগম, যিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে। জানালেন কোটালীপাড়া বাজারে তাঁর পোশাকের দোকান আছে। ব্যবসার মালামাল আনার জন্য নিয়মিত ঢাকা যেতে হতো। এখন সকালে ঢাকা গিয়ে দুপুরেই ফিরে যেতে পারবেন বলে জানালেন।

কাঁঠালবাড়ি সড়কে বাঁশি বাজিয়ে আনন্দ করছিলেন ৫০ থেকে ৬০ তরুণ। তাঁদের একজন দিদারুল করিম এসেছেন বরিশালের গৌরনদী থেকে। উচ্ছ্বসিত দিদারুল বলেন, ‘কালের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। যে কী আনন্দিত, তা বলে বোঝাতে পারব না।’

দুপুরে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী কার্যক্রম শেষ করার পরই উচ্ছ্বসিত মানুষ সেতুতে উঠে যান। বেলা একটার দিকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে পদ্মা সেতুতে ওঠেন শরীয়তপুরের তরুণ হেমন্ত দাস। তিনি হেঁটে সেতুর তিন কিলোমিটার অংশ পর্যন্ত চলে আসেন। পুলিশের বাধায় আবার মাওয়া প্রান্তে ফিরে যান। জাজিরা প্রান্ত থেকে সেতুতে ওঠার জন্য স্পিডবোটে নদী পার হয়ে বিকেলে নাওডোবা আসেন হেমন্ত। চেষ্টা করেন সেতুতে ওঠার। কিন্তু সেখানে পুলিশের বাধায় আর সেতুতে উঠতে পারেননি।

সেতুতে ওঠার জন্য সারা দিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অনেক দর্শনার্থীকে সেতুর মাওয়া প্রান্তে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। তাঁরা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তবে সেতুতে উঠতে না পারার জন্য আক্ষেপ করেন। ৭০ বছর বয়সী চম্পা বেগম বলেন, ‘আমি জীবিত অবস্থায় এ সেতু হলো। খুব আশা নিয়ে সেতুর ওপরে ওঠার জন্য ঢাকা থেকে এসেছিলাম। কিন্তু আমাদেরকে উঠতে দেওয়া হলো না।’

ঢাকার ধানমন্ডি থেকে পরিবার নিয়ে পদ্মা সেতু দেখতে এসেছিলেন সেলিনা কবির। তাঁর গ্রামের বাড়ি শিবচর। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সময় সেলিনা কবির ও তাঁর ছোট সন্তান শিমুলিয়া ঘাটের কাছে স্পিডবোট থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যান। সৌভাগ্যবশত তাঁরা সেবার বেঁচে ফিরেছিলেন।

এরপর থেকে তাঁরা গ্রামের বাড়িতে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছিলেন। বললেন, পদ্মা সেতু হওয়ায় এখন নদী পাড়ি দিতে আর কোনো ঝুঁকি নেই। বাড়িও যেতে পারবেন নিয়মিত। সেতুতে উঠতে না পারার আক্ষেপ ছিল তাঁরও।

গতকাল সন্ধ্যায় নাওডোবায় টোল প্লাজার সামনে গিয়ে দেখা গেল, জমাদ্দার মোড় থেকে টোল প্লাজা পর্যন্ত সংযোগ সড়কে মানুষের ঢল। রাত আটটা পর্যন্ত এ সড়কে যানজট ছিল।