‘আমার পেশায় ছেলে কষ্ট পায়’

কাঁধে ব্যাগ আর হাতে হরেক রকমের পণ্য নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করেন রতন কুমার। সোমার সন্ধ্যার পর কাচারি বাজারে।
ছবি: প্রথম আলো

রতন কুমার পাল। বয়স ৫৭ হলেও অভাব-অনটন আর দুশ্চিন্তায় শরীরটা যেন নুইয়ে পড়েছে। এরপরও কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে দিনভর ছুটছেন। শহরের কোলাহলপূর্ণ এলাকায়। ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে বিক্রি করছেন সুলভ মূল্যে হরেক রকমের পণ্য। একসময় তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করতেন। অসুস্থতার কারণে তা আর পারছেন না। ফলে পছন্দের এ পেশা তাঁকে ছাড়তে হয়। পণ্য ফেরি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসারের খরচ চালানোর পর এক ছেলেকে প্রকৌশল বিষয়ে পড়াচ্ছেন।

রতন কুমার রংপুর শহরের পালপাড়ার বাসিন্দা। ফেরি করে এসব পণ্য বিক্রি করার জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর সময় অতি সম্প্রতি তাঁর দেখা মিলল কাচারি বাজার এলাকায়। আগ বাড়িয়ে এসে কিছু একটা কেনার আবদার করলেন। এ সময় তাঁর (রতন) মুখটি যেন মলিন। আধো আধো গলায় কথা বলছেন। ঘাড়ে নিয়েছেন একটি ব্যাগ। হাতে চিরুনি, বাসন মাজার কাপড়, পলিথিনের ভেতর টুথব্রাশ, মুখ দেখার পকেট আয়না। ব্যাগের মধ্যে নেইল পলিশ, চুরি, ফিতা ও মুখের মাস্ক।

রতন কুমারের সঙ্গে অনেক কথা। বললেন, এক জীবনে অনেক জীবনের গল্প। স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। বড় ছেলে রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছেন। এখন পঞ্চম সেমিস্টারে। ছোট মেয়ে পালপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর স্ত্রী গৃহবধূ হলেও বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করেন। আশপাশের এলাকার মানুষের জামাকাপড় মেশিনে সেলাই করে দেন তিনি।

আগের জীবনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগময় কণ্ঠে রতন কুমার বলেন, শহরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ কৈলাশরঞ্জন উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন মানবিক বিভাগে। এরপর রংপুর সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়লেও তিনি পাস করতে পারেননি। শিক্ষাগত যোগ্যতা জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘ইন্টারমিডিয়েট ফেল।’ এরপর সংসারের ঘানি টানতে আয়–রোজগার করতে তিনি ১৯৯০ সালের পর থেকে টিউশনি পেশা বেছে নেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শেখাতেন। বেশ কয়েকটি টিউশনও চলতে থাকে। শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে যে আয় হতো, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন। এই টাকা দিয়ে পরিবারের খাবার জুটত। এভাবে ভালোই চলছিল তাঁর দিনগুলো।

এই পেশা চলার কয়েক বছর পর রতন কুমার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কী ধরনের অসুস্থ, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কথা মনে থাকে না। অনেক কিছু বুঝতে পারি না। ফলে টিউশনি পেশার ছেদ ঘটে। বাড়িতেই চিকিৎসা চলে দীর্ঘদিন। কষ্টের সংসারে আরও কষ্ট বেড়ে যায়। এরপর স্ত্রীর সেলাই মেশিন দিয়ে যে আয় হতো, তা দিয়েই চলে টানাপোড়েনের সংসার। সেই সঙ্গে চিকিৎসার খরচ।’

রতন কুমার বলেন, ‘একসময় সুস্থ হয়ে উঠি। এরই মধ্যে বড় ছেলে ভর্তি হয় রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। এখন পড়ছে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পঞ্চম সেমিস্টারে। বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগে না। নতুন করে যে টিউশনি পেশা শুরু করব, তা–ও হবে না। কেননা, অসুস্থতার কারণে পড়ার বিষয়গুলো হারিয়ে ফেলেছি।’ শেষ পর্যন্ত ভালো থাকতে হলে নিজের কর্ম নিজেরই করতে হবে বলে জোর দিয়ে জানান তিনি।

রতন কুমার বলেন, সাড়ে তিন বছর আগে থেকে নেমে পড়েন এ পেশায়।
আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘রংপুর শহরের বেতপট্টি এলাকার বাসিন্দা একজন ক্রিকেটার (প্রশিক্ষক) তাঁকে একটি ব্যাগ এবং হরেক রকমের কিছু পণ্য কিনে দেন। এসব নিয়ে পথে নেমে পড়ি। করোনার আগে আয়-রোজগার হতো বেশ। দিনে ৫০০-৭০০ টাকা বিক্রি হতো। এখনো হয়। তবে কম। ২০০-৩০০ টাকা। করোনার কারণে শহরে মানুষ কম। তবে মেডিকেল, রেলস্টেশনে বেশি যাই। সারা দিনই হেঁটে চলি।’

এক প্রশ্নের উত্তরে রতন কুমার হেসে বলেন, ‘ছেলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আমার পেশায় ছেলে কষ্ট পায়। কিন্তু কী করার আছে। আমাকে নিজের কর্ম করে চলতে হবে। তবে এ কাজ করতে গিয়ে আমার মোটেই লজ্জা লাগে না। হাঁটাচলা করে শরীরটাও ভালো আছে। আমার জন্য দোয়া করবেন।’