‘আমারে মায়ের লাশ আইনা দে, ঘরের লগে মাটি দিমু’

নিখোঁজ রহিমা বেগমের মেয়ে লিপা মায়ের সন্ধানে কারখানার মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছেন। আজ রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

লিপার (২০) হাতের বেগুনের ঝোল পছন্দ করতেন রহিমা বেগম (৪৮)। বলেছিলেন বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে ফিরে বেগুনের ঝোল দিয়ে ভাত খাবেন। মায়ের জন্য ঝোল রান্না করেছিলেন লিপা। সঙ্গে ঘন করে ডাল আর শুকনা মরিচের আলুভর্তা। তারপর একে একে পেরিয়ে গেছে তিনটি রাত।

কিন্তু লিপার অপেক্ষা ফুরায় না। দিন যায়, রাত যায়। পোড়া কারখানার আগুন নেভে। লিপার বুকের আগুন আর নেভে না। লিপা এদিক–সেদিক ছুটে বেড়ান। কারখানার সামনে বসে থাকেন। এই হাসপাতাল ওই হাসপাতাল ঘোরেন। আশায় থাকেন জীবিত মায়ের যদি দেখা পেয়ে যান একবার। লিপার সে আশা বারবার ভেঙে দেয় ছোট ভাই আরিফ (১৬)। বারবার বোনের কাছে আকুতি জানিয়ে বলে, ‘আমারে মায়ের লাশ আইনা দে, আমি ঘরের লগে মাটি দিমু।’

আজ রোববার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেডের মূল ফটকের বাইরে আরও অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন লিপা। হাতে মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি। এই প্রতিবেদকের পরিচয়পত্র দেখে ছুটে আসেন তিনি। জানতে চান, তাঁর মায়ের সন্ধান দেওয়া যাবে কি না।

কথায় কথায় লিপা জানান, তাঁর মা অনেক পরিশ্রম করতেন। বেতন পেতেন সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। তা–ও ঠিকঠাক দিত না। দুই মাসের ওভারটাইম বাকি, এক মাসের বেতন। তিনি বলেন, ‘মালিকেরা তো পরিশ্রমের মূল্য দিল না, মৃত্যুর যন্ত্রণা দিল। তাগোরে বইলেন, আমাগো পাওনা লাগব না, মায়ের লাশটা হইলেই বাড়ি ফিরা যামু।’ বলতে বলতে লিপার চোখ ভিজে যায়। থেমে থাকেন। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেন, ‘আচ্ছা, সবাই কি মারা গেছে? মায়েরে জীবিত পাওয়ার কোন চান্স নাই?’

কিশোরগঞ্জ সদরে লিপাদের বাড়ি। রূপগঞ্জে থাকেন পুড়ে যাওয়া কারখানার পাশের ৫ নম্বর ক্যানেল এলাকায়। অভাবের সংসারে সচ্ছলতা আনতে আট বছর আগে বড় মেয়েকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে আসেন রহিমা। তিন বছর আগে কাজ নেন সজীব গ্রুপের কারখানাটিতে। পুড়ে যাওয়া ছয়তলা ভবনে নয়, রহিমা কাজ করতেন এই ভবনের পাশের পাঁচতলা ভবনটিতে। সে কথা বলতেই চিৎকার করে কেঁদে ফেলেন লিপা। বিলাপ করেন, ‘মায়েরে মরণ টাইনা নিছে।’ সেদিন নিজের ফ্লোরে কাজ কম থাকায়, পাশের ভবনের চারতলায় নেওয়া হয়েছিল রহিমাকে।

আমার ভাইটার খোঁজ পাইলেন? মায় তো পাগল হইয়া যাইতাছে। কী কইয়া বুঝ দেমু তারে?
ইব্রাহিম, নিখোঁজ কিশোর ইয়াসিনের ভাই

লিপার বাবা সেলিম মিয়া আচার ফেরি করেন। লিপার ভাই আরিফ কাজ করেন রূপগঞ্জের একটি ইস্পাত কারখানায়। লিপা উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছেন। পড়াশোনা শেষ করে কাজে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। মাকে স্বস্তি দিতে চেয়েছিলেন। সে সময় আর পাননি। লিপা এখন চোখেমুখে শঙ্কা নিয়ে জানতে চান, ‘ডিএনএ তো দিছি। কিন্তু যদি না মিলে? কার লাশের লগে কারে মিলাইব?’

রোববার লিপার মতো আরও অনেক নিখোঁজ শ্রমিকের স্বজন তৃতীয় দিনের মতো রূপগঞ্জের কারখানাটির সামনে অপেক্ষা করেছেন। তাঁরা স্বজনদের ছবি হাতে এসেছিলেন। পুড়ে যাওয়া কারখানাটির ভেতরে যেতে চেয়েছিলেন। দেখতে চেয়েছিলেন, কোন আগুন পুড়িয়েছে তাঁদের সব স্বপ্ন, সব আশা। কারখানার নিরাপত্তাকর্মীদের বাধায় তাঁদের কেউ ভেতরে যেতে পারেননি। বিনা কারণেই দিনভর বসে ছিলেন কারখানার সামনের ঢাকা–সিলেট মহাসড়কের পাশে।

সেই স্বজনদের আরেকজন ইব্রাহিম। ইব্রাহিমের ছোট ভাই ইয়াসিন নিখোঁজ বৃহস্পতিবার থেকে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে শনিবার ইব্রাহিমের মা নাজমা বেগম আর তাঁর স্বজনদের কথা হয়েছিল। সে সূত্রেই ইব্রাহিম এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমার ভাইটার খোঁজ পাইলেন? মায় তো পাগল হইয়া যাইতাছে। কী কইয়া বুঝ দেমু তারে?’

নাজমা বেগমের তৃতীয় সন্তানের জন্মের দেড় বছরে অন্য কোথাও সংসার পাতেন স্বামী। তারপর গত ১৫ বছর তিন সন্তানকে নিয়ে একা জীবন জয়ের লড়াই করেছেন। অন্যের বাড়িতে থেকে, পোশাক কারখানায় কাজ করেও ছেলেদের পড়াশোনা করিয়েছেন। শরীরে রোগ পুষেছেন। তবে স্বপ্ন ছিল, ছেলেরা পড়াশোনা করে বড় হবে। নাজমা ভালো জায়গায় চিকিৎসা করবেন। বুক চাপড়ে এমন আরও নানান কথা বলেন, বিলাপ করতে থাকেন নাজমা।

নিখোজ শ্রমিক ইয়াসিনের মা নাজমা বেগমের আহাজারি। গত বৃহস্পতিবার রাতে কারখানার সামনে
ছবি: দিনার মাহমুদ

শনিবার দুপুরে নাজমার সঙ্গে কথা হয়। ইয়াসিনের নিখোঁজ হওয়ার পর লাল মিয়া মসজিদ এলাকাতেই নিজের মায়ের বাড়িতে থাকেন। নাজমার তিন ছেলের মধ্যে ইয়াসিন (১৭) সবার ছোট। রূপগঞ্জের একটি বেসরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র। ইয়াসিনের এক বছরের বড় ইব্রাহিমও উচ্চমাধ্যমিকে পড়েন। বাবার মৃত্যুর পর অভাবের কারণে পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার পর বিদ্যুতের কাজ শেখেন বড় ছেলে ইসমাইল (২৩)। মায়ের সঙ্গে সংসারের হাল ধরেন। চার মাস আগে ছয় হাজার টাকা বেতনে পুড়ে যাওয়া কারখানায় কাজ নেয় ইয়াসিন। সে কাজ করত কারখানাটির চারতলায়।

ইয়াসিনের নিখোঁজ হওয়ার পর ইসমাইলের আর্তনাদ দেখে প্রতিবেশীরা কেঁদেছেন। নিখোঁজের ৪৮ ঘণ্টা পর আর কান্নার শক্তিটুকুও নেই তাঁর। এর মধ্যে ভাইকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশের মার খেয়েছেন। পা ও হাতে পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি লেগেছে।

ইয়াসিনের মা ও ভাইয়েরা বিশ্বাস করেন, ইয়াসিনকে তাঁরা জীবিত অবস্থায় পাবেন। কারখানার দুজন শ্রমিক তাঁদের সে বিশ্বাস তৈরি করেছেন। বৃহস্পতিবার তাঁরা নাজমাকে বলেছেন, আগুন লাগার পর দুই হাত পোড়া অবস্থায় ইয়াসিনকে কারখানার বাইরে দেখা গেছে। তাঁকে গাড়িতে তোলা হচ্ছিল। তারপর থেকেই ছেলের পথ চেয়ে বসে আছেন।

ইব্রাহিম বলেন, ‘ঢাকা নারায়ণগঞ্জের সব হাসপাতালেই খুঁজছি। ঢাকা মেডিকেলে এতগুলা পোড়া লাশ। মায় ডিএনএ দিতে যায় না। মা আশা বানছে, ইয়াসিন সুস্থ হইয়া ফিরা আসব। আমরা জোর কইরা তারে ডিএনএ দেওয়াইছি।’