আমের ফলনে খুশি, ঢলনে দিশেহারা চাষিরা

রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে আম কেনাবেচা
ছবি: প্রথম আলো

এবার আমের মৌসুমে ঝড়ঝাপ্টা কম হয়েছে। আমের ফলনও তাই হয়েছে বেশি। দিতে হচ্ছে ঢলনও। ফলন বেশি হলেও ঢলন বেশি দিতে চাষির চোখ ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই বাজারে আমের জোগান বেশি, ক্রেতা কম। তাই দামও গত বছরের চেয়ে প্রায় অর্ধেক। এই ক্ষতের ওপরে ঢলনটা যেন গোদের ওপর বিষফোড়া। চাষির আমের পাঁচ ভাগের এক ভাগই চলে যায় ঢলনে।

দেশে আমের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাম সুপরিচিত। তবে বাগানের আয়তন চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেশি হলেও আমের ফলন এখন ধানের দেশ নওগাঁয় বেশি। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাশাপাশি থাকে। হালে নওগাঁ জেলাতেও আম চাষ শুরু হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৪ হাজার ৭৩৮ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। রাজশাহীতে ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে, ফলনের লক্ষ্যমাত্র ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৮৩ মেট্রিক টন। আর নওগাঁয় ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর বাগানে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন।

সব মিলিয়ে এই তিন জেলায় ৭ লাখ ৮১ হাজার ৪৮৩ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে আবহাওয়া অনুকূল থাকার কারণে আমের ফলন এবার লক্ষ্যমাত্র ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। তাই বাজারে এবার আমের আমদানিও বেশি। করোনা পরিস্থিতির কারণে বাজারে এবার ক্রেতা কম। এ কারণে এবার বাজারে আমের দাম গত বছরের তুলনায় অর্ধেক। তার ওপর রয়েছে ঢলন।

তিন জেলার এই বিপুল পরিমাণ আম বিক্রির জন্য কোনো বাজার গড়ে ওঠেনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বড় আমের বাজার বসে রাস্তার ওপর। রহনপুরেও রাস্তার দুই ধারেই বসে। রাজশাহীতে বানেশ্বরে ও কামারপাড়ায় রাস্তার ওপর বাজার বসে। সাপাহারেও আমের বাজার বসে রাস্তার দুই ধারে। সব বাজারেই আমচাষিদের কাছ থেকে অলিখিত আইনে ব্যবসায়ীরা ঢলন নিয়ে থাকেন। সবচেয়ে বেশি ঢলন নেওয়া হয় কানসাটে। সেখানে ৫২ কেজিতে মণ ধরে চাষির কাছ থেকে আম কেনা হয়। সাপাহারে ও বানেশ্বরে ৪৮ কেজিতে মণ ধরে চাষির কাছ থেকে আম কেনা হয়।

ঢলন কী

পশ্চিমবঙ্গে ও কুষ্টিয়ায় ঢলতা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে ‘ঢলন’-এর চল রয়েছে। ঢলন শব্দটি ঢলে পড়া ক্রিয়াপদ থেকে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে একদিকে বেশি নেমে যাওয়া। যেমন দাঁড়িপাল্লায় কোনো জিনিস ওজন করার সময় বাটখারার চেয়ে বেশি জিনিস অপর প্রান্তে তুলে দিলে সেদিকের পাল্লাটা যেটুকু ঝুলে পড়ে, সেটাকেই ঢলন বলা হয়। ঢলন কথাটির ব্যবহার এখান থেকেই এসেছে। ব্যবসায়ীরা সাধারণত যেটুকু ঢলে পড়ে সেই টুকুর দাম আর দিতে চান না।

রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে আম কেনাবেচা
ছবি: প্রথম আলো

বানেশ্বর বাজারে একদিন

গত ২৩ জুন বানেশ্বর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কলেজ মাঠ থেকে আমের হাট আবার এসে রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কের ওপরে বসেছে। পুঠিয়ার ধাদাস গ্রামের চাষি আবদুল মোত্তালেব চার ক্যারেট (আম পরিবহনের প্লাস্টিকের ঝুড়ি) লকনা আম নিয়ে এসেছিলেন। চার ক্যারেটের ওজন হয়েছে ১০৮ কেজি। তা থেকে দুই কেজি হিসেবে ক্যারেটের ওজন বাদ দেওয়া হয়েছে আট কেজি। বাকি ১০০ কেজির জন্য দুই মণের দাম দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আড়াই মণ আম নিয়ে এসে দুই মণের দাম পেলাম।’
পুঠিয়া উপজেলার তারাপুর গ্রামের চাষি শরিফুল ইসলাম (৩৪) দুই ক্যারেট আম্রপালি নিয়ে এসেছিলেন। বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৮০০ টাকা মণ দরে। তিনি হিসাব দিলেন, তাঁর দুই ক্যারেট আমের ওজন হয়েছে ৫২ কেজি। এর দুই কেজি শোলা হিসেবে বাদ দেওয়া হয়েছে। চার কেজি বাদ গেছে ক্যারেটের ওজন। বাকি ৪৮ কেজির জন্য এক মণের দাম দেওয়া হয়েছে। এই ঢলনের ব্যাপারে শরিফুল ইসলাম ভীষণ ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, আড়তে বসলেই সবাই যেন বাহাদুর হয়ে যায়। তাদের কিছু বলা যাবে না। আত্মীয়স্বজনও আড়তে বসলে আর চিনতে পারে না।

ঢলন না ডাকাতি

পুঠিয়া উপজেলার চিতলপুকুর এলাকার চাষি মো. পিন্টু দুই ক্যারেট ল্যাংড়া আম এক হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করলেন। তাঁর পিছু পিছু আড়তে গিয়ে দেখা গেল, তাঁর দুই ক্যারেট আমের ওজন হলো ৫৩ কেজি। সেখান থেকে দুই কেজি শোলা বাদ গেল। বাকি ৫১ কেজি থেকে চার কেজি ক্যারেটের ওজন বাদ গেল। এবার বাকি ৪৭ কেজি আমের জন্য পিন্টুকে ৩৯ কেজির দাম দেওয়া হলো। এক মণ আমে পাকি ১০ কেজি বাদ যাচ্ছে দেখে পিণ্টু কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন। বারবার আড়তদারের হাত চেপে ধরতে লাগলেন। আড়তদার তাঁর কথায় কান না দিয়ে উল্টো তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আর বললেন, ‘আরে তুমার নিজের গাছের আম না? আরেক দিন আইসো ঠিক কইরি দিবনি।’ পিন্টু টাকা হাতে ধরতে চায় না। তাঁর চোখ দুটি ছলছল করছে। জোর করে তাঁর হাতে গুঁজে দেওয়া হলো ৩৯ কেজি আমের দাম। আড়ত থেকে বের হয়ে এসে পরিচয় পেয়ে পিন্টু বললেন, ‘ভাই, আপনে সাংবাদিক মানুষ। চোখে দেখলেন কী ডাকাতি, একটা মুখের কথাও বুললেন না!’

আড়তদার যা বলেন

ব্যস্ত সময় কাটছে আড়তদারদের। কারও দম ফেলার সময় নেই। একটু ফাঁকা পাওয়া গেল মেসার্স রিয়াদ ফল ভান্ডারের আড়তদার আবদুর রাজ্জাককে। তাঁর কাছে ঢলনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সরাসারি স্বীকার করলেন। বললেন, ‘এটা তো লুকোচুরির কিছু নেই। কাঁচামাল সব সময় কিছু নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য তাঁরা ক্যারেটের ওজন বাদ দিয়ে ৪৭ কেজিতে মণ ধরে আম কেনেন। তাঁরা নিজেরাও পাইকারদের কাছে ৪৫ কেজিতে মণ হিসেবে বিক্রি করেন। ঢাকায় কত কেজিতে মণ বিক্রি হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা তাঁরা জানেন না।

প্রশাসনের উদ্যোগ ব্যর্থ

এই বাজারের ঢলন বন্ধ করার জন্য গত বছর পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ একটি সভা আহ্বান করেছিলেন। গত বছর ২৩ অক্টোবর বানেশ্বর বাজার বণিক সমিতির কার্যালয়ে ওই সভা হয়। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ী, চাষি, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সাংসদ মুনসুর রহমান, বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম হিরা বাচ্চু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ। সভাপতিত্ব করেন বানেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গাজী সুলতান। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বানেশ্বর বাজারে ৪০ কেজিতে মণ ধরেই চাষির কাছ থেকে পণ্য কিনতে হবে।

ইউএনও নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ বলেছিলেন, ব্যবসায়ীরা বানেশ্বর বাজার থেকে কৃষকের কাছ থেকে ঢলন নেন, কিন্তু রাজশাহীর বাইরে গিয়ে তাঁদের আর ঢলন দিয়ে বিক্রি করতে হয় না। এখানে ৪৮ কেজিতে মণ ধরে তাঁরা আম কিনেছেন। কিন্তু ঢাকায় তাঁরা ৪০ কেজিতে মণ হিসেবেই বিক্রি করেছেন। যেহেতু তাঁরা ঢাকায় গিয়ে ঢলন দেন না। অতএব বানেশ্বরেও ৪০ কেজিতে মণ ধরে সব কৃষিপণ্য কিনতে হবে।

আম বিপণনের উন্নয়ন দরকার

আম রাজশাহী অঞ্চলের একটি প্রধান অর্থকরী ফসল। অথচ এই আমের উন্নত বিপণন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। রাস্তার ধারে বাজার বসে। কোথাও ৪৮ কেজিতে মণ বিক্রি হয়, আবার কোথাও ৫২ কেজিতে মণ বিক্রি হয়। কোনো বছর দাম বেশি আবার কোনো বছর একেবারেই কমে যায়। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা পারলে ঠিকা দরে কিনতে চায়। আমের বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি।

নওগাঁ শাহ কৃষি জাদুঘর ও পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর শাহ বলেন, ভোক্তার কাছে ফরমালিনমুক্ত নিরাপদ আম পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রশাসন যেভাবে আম পাড়ার একটা ক্যালেন্ডার চালু করেছে, সেভাবেই আমচাষিদের সুরক্ষার জন্য এ অঞ্চলে একটি সুষ্ঠু আম বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। যাতে দামে ও ওজনে চাষিরা না ঠকেন।