আ.লীগকে দুর্বল করার পাঁয়তারা দেখছে দৌলতপুরের চৌধুরী পরিবার

কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি রেজাউল হক চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে উপজেলা যুব জোটের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক মাহবুব খান ওরফে সালাম হত্যা মামলা ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে উপজেলার রাজনৈতিক অঙ্গন। এ মামলায় স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরীর তিন ভাইসহ তাঁর পরিবারের ছয়জন সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাকি আসামিরাও ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মী।

আরও পড়ুন

উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের আমদহ গ্রামে গত বুধবার রাতে মাহবুব খানকে রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত মাহবুব আমদহ গ্রামের এনামুল হকের ছেলে। তিনি মৌসুমি বিভিন্ন ব্যবসা করতেন। ঘটনার পরদিন রাতে এনামুল হক বাদী হয়ে দৌলতপুর থানায় ৩১ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এজাহারভুক্ত আসামি ২২ জন, বাকিরা অজ্ঞাত। এই হত্যা মামলায় এরই মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

মামলায় ছয়জন আসামি কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি রেজাউল হক চৌধুরীর আত্মীয়। এর মধ্যে তিনজন তাঁর আপন ভাই। তাঁরা হলেন ১ নম্বর আসামি সেলিম চৌধুরী, ২ নম্বর আসামি বুলবুল আহমেদ ওরফে টোকেন চৌধুরী ও আসাদুজ্জামান চৌধুরী। আসামিদের মধ্যে রেজাউলের অপর তিন নিকটাত্মীয় হলেন আনিছুর রহমান, তোষণ চৌধুরী ও রোকনুজ্জামান।

এর মধ্যে সেলিম দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও হোগলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, বুলবুল আহমেদ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও আসাদুজ্জামান উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য।

মাহবুব খান হত্যা মামলায় ঢালাওভাবে নিজের স্বজনদের আসামি করার পেছনে চক্রান্তে দেখছেন রেজাউল হক চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় রাজনৈতিকভাবে হেয় করতে আমার পরিবারের সদস্যদের আসামি করা হয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এলাকায় আমার নেতা–কর্মী ও সমর্থক বেশি। আমাদের ঘায়েল করতে পারলে বিরোধীরা বেশি সুবিধা পাবে। সেটাকে পুঁজি করে দলের কয়েকজন নেতা এবং দলের বাইরে থেকে ফায়দা নিতে জাসদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তবে এসব করে কোনো সুবিধা তাঁরা পাবেন না।’

এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে জাসদের নেতা–কর্মীরা আসামিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে প্রতিদিন উপজেলা ও জেলাতে প্রতিবাদ সভা করছেন। এই মামলাকে হয়রানিমূলক উল্লেখ করে রেজাউল হকের অনুসারীরাও এলাকায় বিক্ষোভ করছে। গত রোববার উপজেলা পরিষদ চত্বরে জাসদ ও আওয়ামী লীগ একই স্থানে সভা আহ্বান করে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সেটি বন্ধ হয়। এর আগে শনিবার উপজেলার আল্লারদর্গা বাজার এলাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে জেলা ও উপজেলার নেতারা অংশ নেন। সেখানে চৌধুরী পরিবারের পাশে আওয়ামী লীগের একটি অংশ দাঁড়ালেও আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম সরওয়ার জাহানের অনুগতরা যাননি।

চৌধুরী পরিবারের লোকজনের অভিযোগ, আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে জাসদ বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে এক হয়েছে। জাসদ এককাট্টা হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরীর পরিবারের সবাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি নিজে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। তাঁর ভাই হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম চৌধুরী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। আরেক ভাই বুলবুল আহমেদ চৌধুরী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চৌধুরী পরিবারের আধিপত্য রয়েছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আফাজ উদ্দিন মারা যাওয়ার পর বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম সরওয়ার জাহান সভাপতির পদ পান। তবে সরওয়ার জাহানের চেয়ে উপজেলায় রেজাউল হক চৌধুরীর অনুসারী ও নেতা–কর্মীর সংখ্যা বেশি। তাঁর অনুগত নেতারা বলছেন, মাহবুব হত্যাকাণ্ড ঘিরে দলের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে ফায়দা লুটছেন। এতে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মামলার ২ নম্বর আসামি বুলবুল আহমেদ দেশের বাইরে থেকে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই আমি স্ত্রীসহ দেশের বাইরে আছি। আমার স্ত্রীর চিকিৎসা চলছে। এরপরও আমাকে আসামি করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই সাজানো মামলা দেওয়া হয়েছে।’

গত শনিবারের সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগ নেতারা জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। সামনে নির্বাচনে ইনুকে ভোটের মাঠে নামতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তাঁরা। জাসদের অপকর্ম আড়াল করতে এবং আওয়ামী লীগকে হেয় করার জন্য এ মামলা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন রেজাউল হক চৌধুরীর অনুসারীরা।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগ সমর্থন করে না। যুব জোটের নেতা হত্যাকাণ্ডের নিন্দা আমরাও জানাই। তবে ঘোলা পানিতে কাউকে মাছ শিকার করতে দেওয়া হবে না। মাহবুব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো সম্পর্ক নেই। মিথ্যা মামলা দিয়ে নেতাদের হয়রানি করতে এমন মামলা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত হত্যাকারীদের আড়াল করতে আওয়ামী লীগ নেতাদের আসামি করা হয়েছে।’

দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাবীদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত এক সপ্তাহ এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজ করেছি। আজ মঙ্গলবার থেকে মামলার তদন্তকাজে হাতে দেওয়া হয়েছে। কে কাকে কোন রাজনীতি নিয়ে দোষারোপ করছে, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। তদন্তের মাধ্যমে ঘটনায় জড়িত প্রকৃত আসামিদের খুঁজে বের করা হবে। এটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে কোনো নিরপরাধ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’