আলুতে এঁরা বেশি লাভে, ওঁরা কম

২২ শতক জমিতে আলু চাষ করতে গিয়ে বেশ কিছু দেনা হয়েছিল প্রান্তিক চাষি দেলোয়ার হোসেনের। সার ও কীটনাশক কিনেছিলেন বাকিতে। তাই আলু তোলার সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদের জন্য কিছু রেখে বাকিটা সামান্য লাভে বিক্রি করে দেন। বিক্রির সময় দাম পান প্রতি মণ ৪০০–৪৫০ টাকা। সময়টা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।


এরপর জুলাই মাস থেকে বন্যা শুরু হলে আলুর দাম বাড়তে থাকে। জুলাই মাসে প্রতি মণ আলু ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন তা বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি সর্বনিম্ন ১ হাজার ২০০ টাকা। তবে এ লাভের ভাগীদার শুধু হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করে রাখা ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক আলুচাষিরা।

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় আলু নিয়ে এমন বেশি লাভ–কম লাভের চিত্র দেখা গেছে। প্রান্তিক চাষিরা কম লাভে আলু বিক্রি করলেও লাভবান হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করে বদলে গেছে তাঁদের তহবিল। তাঁদের ভাষায়, আলুতে এত লাভ কখনো করেননি।দুই দফায় বন্যার কারণে সবজিখেতের ক্ষতি হওয়ায় ও বাজারে আলুর চাহিদা থাকায় দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে।

সংরক্ষণে লাভবান তাঁরা

উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত মৌসুমে উপজেলায় ৯ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে মোট ২ লাখ ২ হাজার ৫১৫ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদিত আলুর মধ্যে উপজেলার পাঁচটি হিমাগারে মাত্র ৪০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব হয়েছে। লাভের আশায় চাষি ও ব্যবসায়ীরা হিমাগারে তাঁদের উৎপাদিত আলু সংরক্ষণ করেন। তবে বিভিন্ন সমস্যার কারণে প্রান্তিক চাষিরা তাঁদের উৎপাদিত আলু সংরক্ষণ করতে পারেননি। তাঁরা শুধু বীজের আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করে অবশিষ্ট উৎপাদিত আলু শুরুতেই কম দামে বিক্রি করেছেন হাটবাজারে।

এদিকে গত জুলাই মাস থেকে বন্যা শুরু হলে আলুর দাম বাড়তে থাকে। এলাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানিতে সবজিখেত তলিয়ে যাওয়ার কারণে আলুর চাহিদা দেখা দেয়।

ব্যবসায়ী ও চাষিদের সঙ্গে কথা বলে ও হিমাগারগুলোতে গিয়ে জানা যায়, দেড় মাস ধরে আলুর বাজার চাঙা হয়েছে। এ সময়ে আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণে হিমাগারে আলু সংরক্ষণকারীদের মুখে হাসি দেখা দেয়।

উপজেলার বাসুপাড়ার প্রান্তিক চাষি দেলোয়ার হোসেন, গনিপুরের মোজাফ্ফর হোসেন, মাড়িয়ার আসাদুল ইসলামসহ কয়েকজন জানান, আলু ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সামান্য পরিমাণ বাড়িতে রেখে সেগুলো কম দামে বিক্রি করে দিয়েছেন। বিক্রি করা টাকায় পরবর্তী সময়ে ভুট্টা চাষ করেছেন। এ ছাড়া সার ও কীটনাশকের বাকির টাকা পরিশোধ করেছেন। এসব কারণে আগ্রহ থাকার পরও তাঁরা হিমাগারে আলু রাখতে পারেন না বলে জানিয়েছেন।

লাভ হচ্ছে দ্বিগুণ

উপজেলার দেউলাতে অবস্থিত নাটোর কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক সৈয়দ মোশারফ হোসেন বলেন, হিমাগারগুলোতে মূলত ব্যবসায়ীরাই বেশি আলু সংরক্ষণ করে থাকেন। আলু বিক্রির লাভ-ক্ষতি তাঁরাই ভোগ করেন। প্রান্তিক চাষি পর্যায়ে খুব কম পরিমাণ আলু সংরক্ষণ করা হয়।

হিমাগারের কোষাধ্যক্ষ হানিফ উদ্দিন বলেন, এবার প্রতি বস্তা (৬০ কেজি) আলু ৫০০-৬০০ টাকা লাভে বিক্রি হচ্ছে। হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করে সর্বোচ্চ লাভের মুখ দেখছেন ব্যবসায়ী ও চাষিরা।

দেউলা গ্রামের ব্যবসায়ী সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, তিনি এবার পাঁচ হাজার বস্তা আলু হিমাগারে রেখেছেন। ভালো দামে কিছু বিক্রি করেছেন। পর্যায়ক্রমে দাম বাড়ায় কিছু রেখে দিয়েছেন।

সাইদুর রহমান নামের আরেক ব্যবসায়ী জানান, তিনি জমি ইজারা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে আলু চাষ করেছিলেন। সেখানে উৎপাদিত আলুর সবগুলোই হিমাগারে রেখেছেন। ভালো দাম পেয়েছেন, যা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, এবার আলু রেখে তাঁদের আর্থিক তহবিল পাল্টে গেছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাজিবুর রহমান বলেন, দুই দফায় বন্যার কারণে অনেক সবজিখেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাজারে এখনো পর্যাপ্ত সবজি ওঠেনি। এ জন্য বাজারে আলুর চাহিদা রয়েছে। এবার এত লাভ হবে, তা ব্যবসায়ীরাও ভাবতে পারেননি। ভালো দাম পাওয়াতে চাষি ও ব্যবসায়ীরা আগামীতে আলু চাষে ঝুঁকবেন। তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রান্তিক চাষিরা আলুর ভালো দাম পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, তাঁরা আলু খেত থেকে ওঠার পরেই বিক্রি করতে বাধ্য হন। তাই তাঁরা লাভের মুখ দেখতে পান না।