আলোহীন চোখে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন মিফতাহুল জান্নাতের

জয়িতা সম্মাননা পেয়েছেন বগুড়ার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মিফতাহুল জান্নাত। সোমবার রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে
ছবি: সংগৃহীত

আলোহীন দুচোখ তাঁর। পৃথিবীর রূপ-রং কিছুই দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাই মনের আলোতেই পৃথিবী জয়ের একবুক স্বপ্ন মিফতাহুল জান্নাত ওরফে হীরার। দৃষ্টিহীন হয়েও শত বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে চলেছেন। পরিশ্রম, সাহস আর প্রতিনিয়ত স্বপ্ন বুনে বুনে সাফল্য ছোঁয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। পৃথিবীকে জানার অদম্য চেষ্টা নিয়ে একের পর এক স্বপ্ন ছুঁয়ে যাচ্ছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মিফতাহুল।

এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর মিফতাহুল ভর্তি হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে। তবে এসব সাফল্য ছাপিয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সাধারণ পরিবারের মেয়ে মিফতাহুল জান্নাত পেয়েছেন জয়িতা পুরস্কার। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দেশসেরা জয়িতার সম্মাননা পান তিনি।

সোমবার রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মিফতাহুল জান্নাত অতিথিদের কাছ থেকে দেশসেরা জয়িতার সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি বক্তৃতা করেন। সভাপতিত্ব করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা।

মিফতাহুল জান্নাতের পারিবারিক গল্পটাও সংগ্রামের। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার গ্রামের দরিদ্র কৃষক আবদুস সাত্তারের ৯ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। ভাইবোনের মধ্যে তিন বোনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। বড় দুই বোন রেশমা খাতুন ও লাভলী খাতুনও জন্মান্ধ। আলোহীন চোখে লেখাপড়ার সুযোগ সীমিত হওয়ায় বোন রেশমার পড়ালেখায় ছেদ পড়ে অনেক আগেই। তবে কোনো কিছুই সাফল্যের পথে বাধা হতে পারেনি মিফতাহুল জান্নাতের। শৈশবে জন্মান্ধ দুই বোন লাভলী ও মিফতাহুলের পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে এগিয়ে আসে ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট ফর ব্লাইন্ড চিলড্রেন (এবিসি) নামের একটি সংস্থা। পাঁচ বছর বয়সে ২০০১ সালে তাঁরা গাজীপুরের সালনায় এবিসির অন্ধ স্কুলে ভর্তি হন। সেখানেই দুই বোন ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ালেখা শেখেন।

জয়দেবপুর জকী স্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন মিফতাহুল। ২০১২ সালে সালনা নাসির উদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে তিনি জিপিএ-৪ নিয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন বগুড়ার সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজের মানবিক বিভাগে। ২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। মিফতাহুলের স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়ার। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট আর দারিদ্র্য স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অদম্য চেষ্টায় ঋণ করে শেষ পর্যন্ত ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে। প্রথম বিভাগে স্নাতক পাস করার পর এখন পড়ছেন মাস্টার্সে।

কোনো দিন একবেলা, কোনো দিন না খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন মিফতাহুল জান্নাত। প্রতিবন্ধীবান্ধব সংগঠনের ছাত্রকল্যাণ তহবিল থেকে পাওয়া এক হাজার টাকায় প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ফি জমা দেন। পরবর্তী এক বছর পিডিএফ নামের একটি সংস্থা প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে শিক্ষাবৃত্তি দেয়। এরপর সম্মিলন ফাইন্ডেশনে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল বইয়ের প্রুফ রিডার পদে খণ্ডকালীন কাজ নেন তিনি। সম্মানীর সামান্য অর্থ দিয়ে খুব কষ্টে পড়ালেখার খরচ চালিয়েছেন তিনি।

আলোহীন চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে মিফতাহুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করতে পেরেছেন বলে জানান বগুড়া জেলা মহিলাবিষয় কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, কঠোর পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় সাফল্য দেখানোয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় মিফতাহুল জান্নাতকে সেরা ‘জয়িতা পদক ২০২১’ প্রদান করেছে।

অদম্য চেষ্টা আর পরিশ্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছেন বলে মনে করেন জীবনসংগ্রামী তরুণী মিফতাহুল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ, অর্থের অভাবে প্রযুক্তির ছোঁয়া থেকে দূরে থাকার কারণে আগামীর যাত্রা কতটা দুঃসহ হবে, সেটা নিয়েও তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। তবে দমে যান না, থেমে থাকেন না। বরং আকাশছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যান। আত্মপ্রত্যয়ী এই তরুণীর ইচ্ছা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার।

অদম্য মিফতাহুল জান্নাত বলেন, ‘অজোপাড়া গাঁয়ের সাধারণ পরিবার থেকে আলোহীন চোখে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। স্বপ্ন আছে আরও এগিয়ে যাওয়ার। এত দূর যখন আসতে পেরেছি, স্বপ্ন ছুঁতেও আমি পারব, পারতেই হবে।’