দায় স্বীকার করে আদালতে একজনের জবানবন্দি

প্রতীকী ছবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ব্যাংকের শাখায় নিরাপত্তাকর্মীকে খুন করে ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টার ঘটনায় দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন এক আসামি। ওই আসামির নাম জামাল হোসেন ওরফে মাসুদ (২৪)। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে জামালসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ বুধবার দুপুরে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আনিসুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

ব্যাংকে হত্যা ও ডাকাতির চেষ্টার ঘটনাটি গত ২৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবারের। ওই দিন মধ্যরাতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) আশুগঞ্জ শাখার নিরাপত্তাকর্মী রাজেশ বিশ্বাসকে (২৩) খুন করে ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা করেন অভিযুক্ত আসামিরা। ঘটনার পর সাপ্তাহিক সরকারি ছুটি থাকায় তখন ঘটনাটি কেউই জানতে পারেনি। ঘটনা প্রকাশ্যে আসে ২৬ সেপ্টেম্বর, শনিবার রাতে। ওই দিন রাত পৌনে ১২টার দিকে বিডিবিএলের ওই শাখা থেকে নিরাপত্তাকর্মী রাজেশের হাত-পা ও মুখ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। খুন হওয়া রাজেশ সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার চান্দপুর গ্রামের ক্ষীরোদ বিশ্বাসের ছেলে।

আরও পড়ুন

পরদিন রোববার অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে বিডিবিএল আশুগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মোবাশ্বের হোসেন আশুগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলায় নিরাপত্তাকর্মী খুন ও ব্যাংকের ভেতরে অনুপ্রবেশ, চুরি ও ভল্ট লুটের চেষ্টার অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।

এ ঘটনার পর ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত আলামতের মাধ্যমে পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারজনকে শনাক্ত করা হয়। তাঁরা হলেন উপজেলার বগৈর এলাকার জামাল হোসেন ওরফে মাসুদ (২৪), আড়াইসিধা গ্রামের মো. জামিল (২৮) ও সাদ্দাম হোসেন (২৭) এবং নরসিংদীর রায়পুরার মাঝেরচর এলাকার বাসিন্দা মাসুম কবির (৩৮)। মাসুম বর্তমানে আশুগঞ্জের চরচারতলায় বসবাস করেন। সোমবার দিবাগত রাতে উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের চারজনকেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ভবানীপুর সেতু থেকে জামিল, পৌনে ১টার দিকে আড়াইসিধা এলাকা থেকে সাদ্দাম, পৌনে ২টার দিকে ভবানীপুর এলাকা থেকে জামাল এবং রাত সোয়া ২টার দিকে শরীয়তনগর এলাকা থেকে মাসুমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের ব্যাংকের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতা জামাল ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদ হোসাইন গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে জামালের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নথিভুক্ত করেন। আর জামিল ও মাসুমকে আজ আদালতে তোলা হলে আদালত তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

যেভাবে ডাকাতির পরিকল্পনা

আজ সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার বলেন, ব্যাংক ডাকাতির উদ্দেশ্যেই লোহার রেঞ্জ ও শাবল দিয়ে আঘাত করে রাজেশকে হত্যা করা হয়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জামাল তাঁর পাঁচ সহযোগীর নাম প্রকাশ করেন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার অপর তিনজন ছাড়াও মোস্তাক ও শাহাদাত নামের দুজনের জড়িত থাকার কথা জানা যায়। তাঁদের ছয়জনকেই মামলার আসামি দেখানো হয়েছে। ছয়জনই পরস্পরের বন্ধু। চারজন গ্রেপ্তার হলেও মোস্তাক ও শাহাদাত বর্তমানে পলাতক। তাঁদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

পুলিশ সুপার জানান, উপজেলার শরীয়তনগরে শাহাদাতের দোকানে প্রায়ই আড্ডা দেন ও নেশা করেন আসামিরা।  ৪ সেপ্টেম্বর হাতে টাকাপয়সা নেই জানান জামালের সহযোগী আসামিরা। তখন ছয়জন মিলে টাকা জোগাড়ে ‘একটি বড় কাজ’ হিসেবে ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা করেন। তাঁরা আশুগঞ্জে সোনালী ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, বিডিবিএল ব্যাংকে ডাকাতির পরিকল্পনা করার জন্য খোঁজখবর নিতে থাকেন। আশুগঞ্জ বাজারের মধ্যে অবস্থিত এবং সেখানে সব সময় লোকজনের আনাগোনা থাকে বলে সোনালী ব্যাংক লুট করার পরিকল্পনা বাদ দেন তাঁরা। চারপাশে অনেক বেশি সিসি ক্যামেরা থাকায় উপজেলার প্রিমিয়ার ব্যাংক শাখায় লুট করার পরিকল্পনাও বাদ দেন তাঁরা। তবে ব্যাংকের পেছনে চলাচলের গলি এবং একটি অরক্ষিত জানালা থাকায় বিডিবিএলের আশুগঞ্জ শাখায় লুট করা সুবিধাজনক হবে পরিকল্পনা করেন আসামিরা।

পুলিশ সুপার বলেন, পরিকল্পনা মোতাবেক জামিল ও জামাল ব্যাংকের পেছনের দিকে জানালার গ্রিল কেটে ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশ করেন। সে সময় মোস্তাক গলির মধ্যে পাহারা দেন। শাহাদাত নিজের দোকানের মধ্যে বসে এবং মাসুম রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজনের গতিবিধি লক্ষ করেন। জামাল ও জামিল ব্যাংকের মধ্যে প্রবেশ করে নিরাপত্তাকর্মী রাজেশকে লোহার শাবল ও রেঞ্জ দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করেন। পরে গামছা দিয়ে হাত এবং লুঙ্গি দিয়ে মুখ বেঁধে রাজেশকে খুন করেন। পরে ব্যবস্থাপকের কক্ষে গিয়ে সিসি ক্যামেরার ডিভিআরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। এ সময় ব্যবস্থাপকের টেবিল থেকে একটি ল্যাপটপ ও পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যান তাঁরা। একপর্যায়ে ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা লুটের চেষ্টা করেন। কিন্তু ভল্ট ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ব্যাংকের শাখাটি থেকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন তাঁরা।

এসপি আনিসুর রহমান বলেন, জামিলের দেওয়া তথ্যমতে পুলিশ জামালের কাছে থেকে ডাকাতির সময় ব্যাংক থেকে নিয়ে যাওয়া ব্যবস্থাপক মোবাশ্বেরের ল্যাপটপ, পাঁচ হাজার টাকা ও নিহতের একটি মুঠোফোন উদ্ধার করেছে। খোয়া যাওয়া ব্যাংকের ভল্টের দুটি চাবি এখনো উদ্ধার করা যায়নি।

সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) রইছ উদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোজাম্মেল হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর দপ্তর) আবু সাঈদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নবীনগর সার্কেল) মকবুল হোসেন, জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) আলাউদ্দিন চৌধুরী, সহকারী পুলিশ সুপার (সরাইল সার্কেল) আনিসুর রহমান, ডিআইও-১ ইমতিয়াজ আহাম্মদ ও আশুগঞ্জ থানা-পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদ মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।