আশ্রয়ণের জন্য খাল ভরাট

বন্যা, জলাবদ্ধতাসহ অন্তত ৩০০ বিঘা ফসলি জমির ক্ষতির আশঙ্কা। ভোগান্তির মুখে তিন হাজার কৃষক।

খালের প্রায় এক কিলোমিটার ভরাট করে চলছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের কাজ। গত বুধবার মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পশ্চিমপাড়া এলাকায়
ছবি: অজয় কুন্ডু

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ভূমি ব্যবহারের নীতিমালা অনুযায়ী জলাশয় ভরাট করে কোনো প্রকল্প প্রস্তাব করা যাবে না। অথচ মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের ‘সেনখাল’ নামের একটি খালের প্রায় এক কিলোমিটার অংশ ভরাট করে চলছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের কাজ।

এদিকে খাল ভরাটের ফলে বন্যা, জলাবদ্ধতাসহ অন্তত ৩০০ বিঘা ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা স্থানীয়দের। এ বিষয়ে চলতি মাসের ৮ জুন জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন তাঁরা। একই সঙ্গে আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্থানটি পুনর্নির্ধারণ করে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়াসহ খালটি খননের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ অধীনে রাজৈর উপজেলায় ৪টি স্থানে গৃহহীনদের জন্য ১২০টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। চারটির মধ্যে একটি হচ্ছে আমগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া এলাকায়। এখানে সেনখালের ২ একর ৫ শতাংশ জমি ভরাট করে ৩৫টি ঘর নির্মাণ করা হবে। এখন চলছে মাটি দিয়ে খাল ভরাটের কাজ। প্রতিটি ঘরের জন্য এখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ৭২ নম্বর সিরাজকাঁঠি পাবনীয়া মৌজায় আরএস ও বিআরএস দাগ নম্বর ৬৬৫ ও ৮২৯ নকশায় খালের জমি। খালটি কৃষিকাজে সেচ, দেশীয় মাছের উৎস, পাট প্রক্রিয়াজাতকরণ, বর্ষার পানিনিষ্কাশন, কৃষিপণ্য পরিবহনসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। খালটির পাশ দিয়ে ৩০০ বিঘা জমির চাষাবাদ খরা মৌসুমে খালের পানির ওপর নির্ভরশীল। খাল ভরাটের ফলে স্থানীয় কৃষি কাজের বিরূপ প্রভাব পড়বে। ক্ষতির মুখে পড়বেন প্রায় তিন হাজার কৃষক।

গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেনখালের উভয় পাড় দিয়ে চলাচলের জন্য রয়েছে একটি কাঁচা রাস্তা। আশ্রয়ণ প্রকল্পের নির্ধারিত জায়গায় চলছে মাটি ভরাটের কাজ। এ জন্য খালের মধ্যে দেওয়া হয়েছে একাধিক বাঁধ। খালে পানিপ্রবাহ নেই। কাটা হয়েছে খালের দুই পাড়ের কয়েক শ ছোট-বড় গাছ। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য ইট-বালু ইতিমধ্যে খালের পাড়ে আনা হয়েছে।

স্থানীয় কৃষক শচীন বৈরাগী বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। জমি চাষ কইরা যা পাই, তা-ই খাই। খাল ভরাট হয়ে গেলে আমরা না খেয়ে মারা যামু। আমাগো সেচ দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। কয়েক পরিবারের জন্য আমরা ফসল ফলাতে পারব না, আমাগো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।’

পরিমল বাড়ৈ নামে আরেক কৃষক বলেন, এই খালে একসময় লঞ্চ, ট্রলার ও নৌকা চলত। দীর্ঘদিন ধরে খালটি না কাটায় পলি পড়ে ভরাট হয়েছে। কিন্তু পানিপ্রবাহ কমবেশি ছিল। যে পানি খালে ছিল, তা দিয়েই এলাকার সবাই কৃষিজমিতে সেচকাজে লাগাত। এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণকাজ করায় খালের পানিপ্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।

স্থানীয় সূত্র জানায়, আমগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়ায় প্রায় আট হাজার মানুষের বসবাস। এখানে বসবাসরত সিংহভাগই কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। এই এলাকার মানুষের কৃষি হচ্ছে প্রধান জীবিকা। শত বছরের পুরোনো এই খালের পানি ব্যবহৃত হয়ে আসছে জমির সেচকাজে।

এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে গত বুধবার খালটি পরিদর্শনে আসেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ফিল্ড অফিসার শাহ ছলিমুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নকশা ও ম্যাপে খাল দেখতে পেয়েছি। কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, খাল ভরাট করে কোনো কাজ করা যাবে না। আমরা চাই খাল রক্ষা করেই কাজ করা হোক।’

ইউএনও মো. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘খাল ভরাট করে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প করছি না। সেনখালটি এখন মৃতপ্রায়। বহু আগে হয়তো এখানে পানিপ্রবাহ ছিল। এটি বর্তমানে রেকর্ডের খাল নয়, নালা বা নিচু শ্রেণির জায়গা। আরএস নকশায় এটি খাল থাকতে পারে। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগটি পেয়েছি। তাদের যেন ক্ষতি না হয়, বিষয়টি দেখব।’