আসতে সাড়ে ৯, যেতে ৩ ঘণ্টা

ফেরি হয়ে গত শুক্রবার বাসে রাজধানীতে এসেছিলেন এই প্রতিবেদক। গতকাল রোববার পদ্মা সেতু হয়ে ফিরে গেলেন বরিশালে।

ঢাকার আকাশে রোববার সকাল থেকেই কড়া রোদ, সঙ্গে ভ্যাপসা গরম। তবু মনটা চনমনে। কারণ, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে বরিশাল যাব। গত শুক্রবার রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া-মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরি হয়ে দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীদের সঙ্গে বাসে রাজধানীতে এসেছিলেন এই প্রতিবেদক। সেটা ছিল ওই অঞ্চলের যাত্রীদের শেষ ফেরিযাত্রা। সেই ইতিহাসের অংশীদার হতে সেদিন বরিশাল থেকে সাড়ে ৯ ঘণ্টার ‘দুর্বিষহ’ যাত্রা শেষে ঢাকায় পৌঁছানোর তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

গতকাল রোববার ঢাকা থেকে রওনা হয়ে পদ্মা সেতু ধরে বরিশালে পৌঁছাতে তিক্ততা তো দূরে থাক, ছিল মনভরা একরাশ উচ্ছ্বাস। প্রথমবার গর্বের সেতু দিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দ। এক দিন আগে ফেরি হয়ে বরিশাল থেকে ঢাকা আসতে যেখানে সাড়ে ৯ ঘণ্টা লেগেছিল, গতকাল ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে বরিশাল পৌঁছাতে সেখানে লাগল তিন ঘণ্টা।

ঢাকার জিগাতলা থেকে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে সায়েদাবাদ এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল সোয়া ১০টা। সকাল থেকে পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর একের পর এক বাস ছাড়তে থাকে। দিনের প্রথম ভাগে সাকুরা, হানিফ, গ্রিনলাইনের বেশ কয়েকটি বাস ছাড়ে। সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আরও কটি বাস ছাড়ার সময়সূচি আছে। কিন্তু কোনো বাসেই টিকিট নেই। হন্যে হয়ে যাত্রীরা ঘুরছেন। সাড়ে ১১টায় একটি টিকিট মিলল ব্যাপারী পরিবহনের একটি বাসে। পৌনে ১২টায় সায়েদাবাদ ছেড়ে এগিয়ে চলছে বাস।

আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম, ভাবতে পারছি না!
সাইফুল ইসলাম, বাসযাত্রী

সবাই জানালার ফাঁক গলে বাইরে তাকিয়ে। কখন স্বপ্নের সেতুতে উঠবে বাস। এই প্রতিবেদকের পাশের সিটে বসা ভোলার এক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান সেই উৎসুক ব্যক্তিদের একজন। তিনি বলছিলেন, ‘ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছি পদ্মা সেতু পার হব এখনই। কমেন্টে সবাই ছবি দেখতে চায়। পদ্মা সেতুতে আমাদের গাড়ি কখন উঠবে?’ ঘড়ির কাঁটায় তখন ১১‌টা ৫৭ মিনিট। এক্সপ্রেসওয়ে ধরে শাঁই শাঁই করে যানগুলো পূর্ণগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দুই পাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে শান্ত হয়ে আসছিল মনপ্রাণ।

১২টা ২৯ মিনিটে বাসটি সেতুর টোল পরিশোধ করে পদ্মা সেতুর দিকে এগোচ্ছে। সংযোগ সড়ক পার হয়ে মূল সেতুতে উঠতেই বাসের ভেতরে যাত্রীদের উচ্ছ্বাস। কেউ চলন্ত বাসের মধ্যেই জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও ধারণ করছেন। মূল সেতুর দেড় কিলোমিটার এগোতেই বাসটি একেবারে সেতুর রেলিংয়ের কাছ ঘেঁষে ব্রেক কষে দাঁড়াল। বাসের স্টিয়ারিং ছেড়ে নিচে নেমে চালক বেল্লাল হোসেন হাঁক দিলেন, ‘আসুন, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে বাংলাদেশ দেখি।’ তখন যাত্রীরা হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠলেন। সবাই একে একে নেমে এলেন স্বপ্নের সেতুর ওপরে। কেউ নাচছেন, কেউ গাইছেন, কেউ হইহুল্লোড় করছেন।

এখানে আলাপ হয় যাত্রী সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। সাইফুল ঢাকার একটি কলেজের ছাত্র। তিনি বরগুনার গ্রামের বাড়ি ফিরছেন। সাইফুল বলছিলেন, ‌‘বছর তিনেক আগে একবার ঈদে ফেরিঘাটে আটকে আর বাড়িতে ঈদ হয়নি। এখন মনে হয় সবকিছু স্বপ্নের মতো।’

‌‘বছর তিনেক আগে একবার ঈদে ফেরিঘাটে আটকে আর বাড়িতে ঈদ হয়নি। এখন মনে হয় সবকিছু স্বপ্নের মতো।’
সাইফুল ইসলাম, ঢাকার একটি কলেজের ছাত্র

এই পদ্মা দক্ষিণের ২১ জেলাকে যুগ যুগ ধরে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। কত স্মৃতি এই নদী ঘিরে। মধু আর বেদনা দুইয়ের মিশেলের স্মৃতি। সেতুর রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে পদ্মার ভরা রূপ, তার বুকে নান্দনিক সেতুর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কলেজছাত্র সাইফুল বলছিলেন, ‘আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম, ভাবতে পারছি না!’

প্রায় ১০ মিনিটের বিরতির পর পুনরায় যাত্রা শুরু। সেতু পার হয়ে আবার এক্সপ্রেসওয়ে। আকাশ তখন গাঢ় মেঘে ছেয়ে গেছে। একটু পরেই বৃষ্টি নামল। গরমে স্বস্তি পান যাত্রীরা।

৫৫ কিলোমিটারের ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েটি যেন অনন্য এক স্থাপনা। ভাঙ্গা গোলচত্বর থেকে এখানে লেনগুলো বিভক্ত হয়ে গেছে নদীর মতো। গোলচত্বরের পাশে গড়ে উঠেছে নানা স্থাপনা, খাবারের দোকান। বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ এখানে আসছেন ঘুরতে।

ভাঙ্গার পর আবার সরু রাস্তা। বাসের গতি কমে যায়। টেকেরহাটের কুমার নদ পার হয়ে আসতে দুই পাশে বিস্তৃত পাটখেত, পুবালি বাতাসে জাগ দেওয়া ভেজা পাটের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। যাত্রীরা কিছুটা ক্ষুধার্ত। তাই গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের একটি পেট্রলপাম্পে আবার যাত্রাবিরতি। সেখানে আরও কয়েকটি বাস থেমেছে।

পাম্পের পাশেই চা-কফি এবং অন্য খাবারের পসরা নিয়ে বসেছেন ফরিদ উদ্দিন। তাঁর দোকানে যাত্রীদের ভিড়। চারজন কর্মচারী ক্রেতা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বেচাবিক্রি কেমন—জানতে চাইলে চওড়া হাসি দিয়ে ফরিদ বললেন, ‌‘খুব ভালো। আগে দিনে ১০-১২ হাজার বেচতাম। আইজকা যে গতি তাতে কুড়ির (২০ হাজার) কাছাকাছি যাইব।’

পুনরায় যাত্রা শুরুর পর চালকের পাশে দাঁড়াতেই তিনি এক যাত্রীকে পেছনের সিটে পাঠিয়ে এই প্রতিবেদককে বসতে দেন। আলাপ জমে তাঁর সঙ্গে। এই প্রথম পদ্মা সেতু পার হলেন? প্রশ্ন শুনে বেল্লাল হোসেন (৩৫) হেসে বললেন, ‘সকাল সাড়ে ৬টায় বরিশালে থেইক্যা গেছি, ঢাকায় পৌঁছাই সাড়ে ৯টায়। আবার ঢাকাত তোন ছাড়ছি অহনও তিন ঘণ্টায় পৌঁছাই দিমু।’

বেল্লালের সঙ্গে কথা না ফুরাতেই বাসটি বরিশাল শহরের নথুল্লাবাদে পৌঁছে গেল। চালকের সহকারী হাঁক দিলেন, ‌‘নামেন, নামেন। বরিশাল আইসা পড়ছি।’ চালক বেল্লালের কথাই ঠিক, তিন ঘণ্টায় যাত্রীরা পৌঁছে গেছেন বরিশালে।