‘আয়শা খানম প্রগতিশীল আন্দোলনের বাতিঘর’

আয়শা খানম।
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়শা খানমের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অধ্যাপক যতীন সরকার বলেছেন, আয়শা খানম এ দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের বাতিঘর। তিনি জীবনভর মানবমুক্তির গান গেয়ে গেছেন।

যতীন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে আয়শা খানম ও আমি একসঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলাম। পার্টির ভাঙন দেখা দিলে তিনি মহিলা পরিষদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। প্রগতিশীল নেতা-কর্মীদের কাছে তিনি পথপ্রদর্শক। তাঁর মৃত্যুতে প্রগতিশীল আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। এ ঘটনায় নেত্রকোনার মানুষ হিসেবে বিশেষভাবে আমি শোকাহত।’

আয়শা খানম (৭৪) আজ শনিবার ভোরে ঢাকায় নিজের বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাজধানীর একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর জন্ম নেত্রকোনার গাবড়াগাতি গ্রামে ১৯৪৭ সালের ১৮ অক্টোবর।

আয়শা খানমের বাড়িতে লোকজনের ভিড়। শনিবার দুপুরে নেত্রকোনা শহরের পূর্ব কাটলী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

আয়শা খানমের সহপাঠী বেসরকারি সংস্থা স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির নির্বাহী পরিচালক বেগম রোকেয়া বলেন, ‘আয়শা ও আমি ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত একই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। তিনি ছোট থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন বাজি ধরে কাজী নজরুল ইসলামের একটি অনেক বড় কবিতা অল্প সময়ের মধ্যে মুখস্থ করে আমাদের অবাক করে দিয়েছিলেন। তিনি সারা জীবন অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের জয়গান গেয়ে গেছেন।’

আজ বেলা তিনটার দিকে আয়শা খানমের মরদেহ নেত্রকোনায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর প্রয়াত স্বামী গোলাম মুর্তুজা খানের প্রতিষ্ঠা করা শহরের পূর্ব কাটলী এলাকায় অন্বেষা বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে বাদ আসর তাঁর জানাজা হবে। রাষ্ট্রীয় সম্মাননা শেষে স্বামীর কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করার কথা।

আয়শা খানমকে শ্রদ্ধা জানাতে পূর্ব কাটলী এলাকায় যান নেত্রকোনা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, আয়শা খানম যখন নেত্রকোনা বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তেন, তখন থেকেই সমাজসচেতন ছিলেন। তিনি মেয়েদের বাইরে নিয়ে আসার সংকল্প করেছিলেন। তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবনভর আন্দোলন করেছেন।

নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল্লাহ এমরান বলেন, ‘আয়শা খানম একজন মানবতাবাদী, নির্লোভ, নিরহংকারী সহজ মানুষ ছিলেন। একজন পরিপূর্ণ মানুষের প্রস্থানে আমরা ব্যথিত।’

আয়শা খানমের বাড়িতে লোকজনের ভিড়। শনিবার দুপুরে নেত্রকোনা শহরের পূর্ব কাটলী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সহসভাপতি আয়শা খানম বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধসহ সব প্রগতিশীল আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ছিলেন। পাকিস্তান আমলে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে যুক্ত তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি রোকেয়া হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৭১ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে নামেন তিনি।

‘ডামি’ রাইফেল হাতে ঢাকায় নারী শিক্ষার্থীদের মিছিলের যে ছবি আলোচিত হয়, তাতে আয়শা খানমও ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজেকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত করেন আয়শা খানম। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসন এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় কাজ করেন তিনি।

আয়শা খানমের ছোট ভাই নেত্রকোনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোহাম্মদ খান পাঠান বলেন, ‘আপা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। গতকাল রাতে তিনি একটু বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকেরা তাঁর মৃত্যুর খবর জানান।’

আরও পড়ুন