ইলিশ নিধনে বেপরোয়া জেলেরা

সংঘবদ্ধ জেলেরা ইউএনওর স্পিডবোটের ওপর হামলা চালান। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার ৫০ কিমিজুড়ে মা ইলিশ নিধন।

  • জেলেদের এমন সহিংস আচরণে নদীতে অভিযান চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মাঠপর্যায়ের মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা।

  • হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জসংলগ্ন মেঘনা ও শাখা নদীতে প্রতিবছরই নিষেধাজ্ঞার সময় এমন হামলার ঘটনা ঘটছে।

ইলিশ মাছ
ফাইল ছবি

ইলিশের প্রজনন মৌসুম নির্বিঘ্ন করতে দেশের সব নদ-নদী ও বঙ্গোপসাগরে ২২ দিনের ইলিশ নিধনে নিষেধাজ্ঞা ৪ অক্টোবর শুরু হয়েছে। বরিশাল বিভাগে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় মৎস্য বিভাগ নদ-নদীতে অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু জেলে মা ইলিশ ধরে চলেছেন। এমনকি অভিযান চালাতে গেলে তাঁরা ভ্রাম্যমাণ আদালত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন।

গত শুক্রবার বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহাদাত হোসেনের নেতৃত্বে মেঘনার শাখা গজারিয়া নদীতে অভিযান চালাতে যান। সংঘবদ্ধ জেলেরা ইউএনওর স্পিডবোটের ওপর ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে হামলা চালান। এতে ইউএনও তাঁর বাঁ পায়ে চোট পান এবং তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক আনসার সদস্য নদীতে পড়ে গেলে তাঁর হাতে থাকা শটগানটি নদীতে ডুবে যায়।

জেলেদের এমন সহিংস আচরণে নদীতে অভিযান চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মাঠপর্যায়ের মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা। বিভাগের কয়েক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, নদীতে অসাধু জেলেরা সংঘবদ্ধ। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রভাবশালী মৎস্য ব্যবসায়ীরা। ফলে মৎস্য বিভাগের একার পক্ষে এ অভিযান সফল করা অসম্ভব। এ জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত অভিযান না হলে অসাধু জেলেদের নিবৃত্ত করা কঠিন।

প্রতিবছরই হামলা

হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জসংলগ্ন মেঘনা ও শাখা নদীতে প্রতিবছরই নিষেধাজ্ঞার সময় এমন হামলার ঘটনা ঘটছে। গত বছরের ১৫ অক্টোবর ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ইলিশবোঝাই পাঁচ-ছয়টি নৌকা আটক করার পর জেলেরা সংঘবদ্ধ হয়ে মেঘনা নদীতে হিজলা নৌ পুলিশের একটি দলের ওপর অতর্কিত হামলা চালান। এতে দুই নৌ পুলিশ সদস্য মনিরুল ইসলাম ও আবু জাফর আহত হয়েছিলেন। ওই বছরের ১৮ অক্টোবর মেহেন্দীগঞ্জসংলগ্ন জাঙ্গালিয়া এলাকার মেঘনা নদীতে মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা পুলিশ নিয়ে অভিযানে গেলে স্থানীয় দুই ইউপি সদস্যের নেতৃত্বে হামলা হয়। ২১ অক্টোবরও ঘটে হামলার ঘটনা। এতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হন। গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাতে হিজলা উপজেলার দেবুয়া এলাকার মেঘনা নদীতে মৎস্য বিভাগের অভিযান চলাকালে হামলার ঘটনা ঘটে।

বিভাগীয় মৎস্য বিভাগ জানায়, ৪ থেকে ১০ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা শুরুর পর ২৬১টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ২ টন ৫৩৩ কেজি ইলিশ জব্দ করা হয়েছে। ১৬৪টি মামলা আর জরিমানা আদায় হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। আর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে ১২০ জেলের।

কেন বেপরোয়া জেলেরা

প্রতিবছরই নিষেধাজ্ঞার সময় মেঘনার এ বিশাল এলাকাজুড়ে বড় বড় মা ইলিশের আনাগোনা থাকে। ফলে জাল ফেললেই বড় আকারের ইলিশ আটকা পড়ে। আকারে বড় এসব ইলিশ ধরার জন্যই মূলত এ এলাকা ঘিরে একটি অসাধু জেলে চক্র নিষেধাজ্ঞার সময়টির জন্য মুখিয়ে থাকে। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকেন স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, প্রভাবশালী মৎস্য ব্যবসায়ী।

এবারও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন মেঘনার সাদিকপুর, আলীগঞ্জ ও মহিষা পয়েন্টের ৫০ কিলোমিটারজুড়ে মা ইলিশ নিধন চলছে। তেঁতুলিয়ার আমীরগঞ্জ ও জাঙ্গালিয়া এবং কালাবদর নদীর লেঙ্গুটিয়া ও বামনীর চর পয়েন্টে অসাধু জেলেরা সকাল ও রাতে মা ইলিশ নিধন করছেন।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির হিজলা উপজেলা শাখার সভাপতি জাকির হোসেন সিকদার অভিযোগ করেন, নিষেধাজ্ঞা শুরুর পর দুদিন মেঘনা নদীতে মৎস্য বিভাগ ও নৌ পুলিশ অভিযান চালায়। এর পর থেকে খানিকটা ঢিলেঢালা ভাব দেখা যায়। এ সুযোগে শত শত জেলে উত্তরে পুরোনো হিজলা থেকে দক্ষিণে বালুর চর পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কিলোমিটার মেঘনায় দেদার মা ইলিশ ধরছেন। আর মেঘনার জানপুর, খালিশপুর ও অন্তরবাম নামের স্থানে বড় বড় ট্রলার নিয়ে মা ইলিশ ধরছে আরেকটি পক্ষ।

জানতে চাইলে বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আনিছুর রহমান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেহেন্দীগঞ্জে ওই হামলার পর আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে মেঘনায় কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশের দুটি অস্থায়ী ভাসমান ঘাঁটি স্থাপনের আবেদন করেছি। আশা করি, সেটি বাস্তবায়ন হবে অচিরেই। তাহলে এ ধরনের সমস্যা কমে যাবে।’