ইয়াবা ও গাঁজায় আসক্ত ছিলেন স্পিডবোটের সেই চালক

পদ্মায় স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণহানির ঘটনায় গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি এলাকায়
প্রথম আলো

মাদারীপুরের শিবচরে দুর্ঘটনার শিকার সেই অবৈধ স্পিডবোটটির চালক মো. শাহ আলম (৩৮) ইয়াবা ও গাঁজায় আসক্ত ছিলেন। শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে করা ডোপ টেস্টে এ তথ্য পাওয়া গেছে। দুর্ঘটনার পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই চালককে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুলিশের নজরদারিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ডোপ টেস্টের বিষয়ে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শশাঙ্ক চন্দ্র ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ডোপ টেস্টে স্পিডবোট চালকের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। অর্থাৎ তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন। রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি এমফিটামিন (ইয়াবা) ও মারিজুয়ানা (গাঁজা) সেবনে আসক্ত। ডোপ টেস্টের রিপোর্ট প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত সোমবার স্পিডবোট দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২৬ জন যাত্রী। এতে আহত হন স্পিডবোটের চালকসহ পাঁচজন। দুর্ঘটনার পরে অবৈধ স্পিডবোটের চালক মো. শাহ আলমকে গুরুতর অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে প্রশাসনের নির্দেশনায় ওই চালকের ডোপ টেস্টের নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয়। পরে আহত ওই চালককে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বর্তমানে ওই চালক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ডোপ টেস্টের কিট মাদারীপুরে না থাকায় ঢাকা থেকে কিট সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য বিভাগ।

এ বিষয়ে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার আগে চালক মাদকসেবন করেছেন। তিনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিলেন। ডোপ টেস্ট থেকে এসব তথ্য পেয়েছেন। বিষয়গুলো তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসবে। পাশাপাশি কোনো মাদকাসক্ত যেন স্পিডবোটচালক না হতে পারেন, বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখা হবে। চালকদের প্রশিক্ষণ, স্পিডবোটের রেজিস্ট্রেশন ও চালকের লাইসেন্স থাকতেই হবে। এসব না থাকলে এখানে আর কোনো অবৈধ নৌযান চলতে দেওয়া যাবে না।

শিমুলিয়া ঘাট থেকে যাত্রী বোঝাই করে স্পিডবোট ছাড়েন চালক। যাত্রার শুরু দিকেই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এলোমেলোভাবে স্পিডবোট চালাচ্ছিলেন তিনি। শুরুতে একবার স্পিডবোট চালকের ভুলে উল্টে যাচ্ছিল।
আদুরী বেগম, দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া স্পিডবোটের যাত্রী

তিনি আরও বলেন, স্পিডবোটচালকদের লাইসেন্স দেওয়ার আগে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হবে। এমনকি নিয়মিত তাঁদের ডোপ টেস্ট করতে হবে। যাঁরা মাদকাসক্ত হবেন বা ডোপ টেস্টে পজিটিভ আসবেন, তাঁদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, স্পিডবোটের চালক শাহ আলম নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার ভাতা ঈদগাহপুর এলাকার আবুল কালামের ছেলে। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করে গাড়ি মেরামতের কাজ শুরু করেন শাহ আলম। প্রায় ১৮ বছর আগে শিমুলিয়ায় আসেন কাজের সন্ধানে। পরে যোগ দেন স্পিডবোট চালক হিসেবে। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। তাঁদের দুই সন্তান থাকে নানার বাড়িতে। শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় শাহ আলম ভ্রাম্যমাণ বসবাস করতেন। নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা এখানে তাঁর নেই।

শাহ আলমের বিষয় জানতে চাইলে তাঁর বাবা আবুল কালাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শাহ আলম তাঁদের টাকা দিতেন না। ঠিকমতো কাজ করতেন না। ইচ্ছা হলে কাজে যেতেন, না হলে যেতেন না। সংসার করেছেন ১৪ বছর। পরে বউয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে একাই ছিলেন। নিজের স্পিডবোট ছিল না। মাসিক বেতনে চাকরি করতেন। নিজের মতো থাকতেন। কাজ ছাড়া আর কী করতেন, তা জানাতেন না।

মাদারীপুরের শিবচরে নৌ দুর্ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

সেদিনের স্পিডবোট দুর্ঘটনায় স্বামী–সন্তানকে হারালেও প্রাণে বেঁচে যান আদুরী বেগম। তিনি চালককে মাদকাসক্ত উল্লেখ করে বলেছিলেন, শিমুলিয়া ঘাট থেকে যাত্রী বোঝাই করে স্পিডবোট ছাড়েন চালক। যাত্রার শুরু দিকেই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এলোমেলোভাবে স্পিডবোট চালাচ্ছিলেন তিনি। শুরুতে একবার স্পিডবোট চালকের ভুলে উল্টে যাচ্ছিল। চালকের কারণেই তিনি স্বামী-সন্তান হারিয়েছেন।

এদিকে স্পিডবোট দুর্ঘটনার পর ওই দিন রাতে মালিক, ইজারাদারসহ চারজনকে আসামি করে মামলা করে নৌ পুলিশ। ঘটনার চার দিন কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। জানতে চাইলে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা চরজানাজাত নৌ পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা হওয়ার পরে আমরা অভিযুক্তদের বাড়িতে রেইড দিই। কিন্তু আসামিরা কেউ বাড়িতে নেই। তাঁদের ধরতে পিআইবি, র‌্যাব, নৌ পুলিশসহ একাধিক টিম কাজ করছে। আশা করছি, খুব দ্রুতই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে।’

তিনি জানান, দুর্ঘটনার শিকার ওই চালক ঢাকা মেডিকেলে পুলিশের নজরদারিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তিনি এখনো শঙ্কামুক্ত নন। মাথায় গুরুতর আঘাত থাকায় কথাও বলতে পারছেন না তিনি।