ইয়ার্ড ছাড়িয়ে বসতঘরে বিষাক্ত অ্যাসবেস্টস

যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়েছে অ্যাসবেস্টস। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের গামারিতল এলাকায়।
প্রথম আলো

ভয়ংকর অ্যাসবেস্টস। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জাহাজভাঙা কারখানার শ্রমিকদের কাছে এটি ‘অ্যালবেস্টর’ হিসেবে পরিচিত। মানবদেহের ফুসফুসের ক্যানসার, অ্যাসবেস্টসিস রোগসহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করা একটি পদার্থ। এমন ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের অধিকাংশ জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে (কারখানা) ঝুঁকিপূর্ণভাবে অ্যাসবেস্টস ভাঙার খবরটি পুরোনো হয়ে গেছে। দেশ-বিদেশের বহু সংবাদমাধ্যমে অ্যাসবেস্টসের বিষ নিয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচারিত হয়েছে কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি।
এখন আরও ভয়ংকর যে ঘটনাটি ঘটছে তা হলো জাহাজভাঙা ইয়ার্ড ছাড়িয়ে অ্যাসবেস্টস ঢুকে যাচ্ছে মানুষের ঘরে। চুলা, খাট, আলমারিসহ নানা আসবাব তৈরি হচ্ছে অ্যাসবেস্টস থেকে। অ্যাসবেস্টসের তৈরি পণ্য দেখতে সুন্দর ও স্বল্প মূল্য হওয়ায় কিনছে নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে উচ্চবিত্তরাও। এতে নিজের অজান্তেই আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
বিষাক্ত অ্যাসবেস্টসে এখন পর্যন্ত কত সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তার কোনো হিসাব না পাওয়া গেলেও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের প্রায় ৩৩ শতাংশ আক্রান্ত বলে জানিয়েছে জাহাজভাঙা কারখানা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ফাউন্ডেশন (ওশি)।
জাহাজভাঙাশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) হিসাব অনুযায়ী, সীতাকুণ্ড উপকূলে ৫০ থেকে ৬০টি জাহাজভাঙা কারখানা চালু রয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় বলছে, এসব কারখানায় গেল বছর বাংলাদেশে ভাঙার জন্য স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে ২০০টির মতো। প্রতিটি জাহাজে অল্পস্বল্প অ্যাসবেস্টস থাকে।
পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) বলছে, আদালতের আদেশ, দেশের প্রচলিত আমদানি নীতি আদেশ এবং জাহাজভাঙাসংক্রান্ত বিধিমালা অনুযায়ী অ্যাসবেস্টস নিয়ে কোনো জাহাজ বাংলাদেশে ঢুকতে পারে না। অথচ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অ্যাসবেস্টস না থাকার মিথ্যা সনদ দিয়ে জাহাজগুলো বাংলাদেশে ঢোকায়।
এরপর অ্যাসবেস্টসের ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকেরা অ্যাসবেস্টসসহ জাহাজ ভাঙেন। ভাঙার সময় জাহাজে থাকা অ্যাসবেস্টসের কিছু অংশ সাগরের পানিতে পড়ে, যা পরে মাটি ও পানিতে মিশে যায়। জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের উপকূলে জাহাজভাঙা কারখানায় ভাঙার জন্য আনা প্রতিটি স্ক্র্যাপ জাহাজে তাপ নিরোধের জন্য পাটাতন, কক্ষগুলোর ছাদ ও মেঝে, দেয়াল, আসবাব, জাহাজের ভেতরে ব্যবহৃত পাইপ, টানেলের ওপরে প্রলেপ আকারে অ্যাসবেস্টস থাকে। এসব স্থান অ্যাসবেস্টস বিচ্ছিন্ন করার সময় ধুলার মতো উড়তে থাকে পদার্থটি। এতেই অসচেতন শ্রমিকদের শরীরে প্রবেশ করে এটি। জাহাজ থেকে ভাঙার কিছু অংশ সাগরে পড়ে মাটি ও পানিতে মিশে যায়। কিছু অংশ কারখানার ভেতরে থাকে। তবে বেশির ভাগ পুরোনো আসবাব লট আকারে বিক্রির সময় বাইরে চলে আসে। যা দ্বারা পুনরায় ব্যবহৃত হয়ে অ্যাসবেস্টস চুলা ও আসবাব তৈরি হয়। এরপর অব্যবহৃত অ্যাসবেস্টস বর্জ্য আকারে ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র। ফলে বাতাস থেকেও হালকা এ পদার্থ মানবদেহে ঢুকছে হরহামেশা।
কিন্তু এদিকে খেয়াল নেই পরিবেশ অধিদপ্তরসহ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর। ফলে বিষাক্ত অ্যাসবেস্টস সড়ক-মহাসড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে উন্মুক্ত স্থানে রাখার কারণে ভয়ংকর অ্যাসবেস্টসিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ।

অ্যাসবেস্টস বোর্ড দিয়ে তৈরি করা আসবাবপত্র। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকায়।
প্রথম আলো

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. দেবাশীষ পালিত বলেন, অ্যাসবেস্টসকে যেখানে-সেখানে ভাঙলে এর কণা বাতাসে মিশে গিয়ে মূলত শ্বাসপ্রশ্বাসের সাহায্যে মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করলেই ক্ষতিটা শুরু হয়। এ ক্ষতি প্রকটতা নির্ভর করে কী পরিমাণ অ্যাসবেস্টস ফুসফুসে প্রবেশ করেছে এবং কত সময় ধরে ফুসফুসে অবস্থান করছে। ফুসফুসে অ্যাসবেস্টরের উপস্থিতির কারণে ক্যানসারও হতে পারে।
পরিবেশ আইনজীবী সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাসবেস্টস এখন শুধু জাহাজভাঙাশ্রমিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এমনভাবে গ্রামে ছড়িয়েছে যে এখন সংশ্লিষ্ট এলাকার গ্রামের মানুষদেরও ক্যানসারের ঝুঁকিতে ফেলছে।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিএসবিআরএর নেতাদের সঙ্গে সভা করেছেন অ্যাসবেস্টস নিয়ে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কারখানায় অঘোষিত পরিদর্শন (সারপ্রাইজ ভিজিট) করে জরিমানা করে চলেছেন, যার ফলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে তাঁর দাবি।

শরীরের জন্য ক্ষতি বলে শুনেছেন। পাউডার না ঢোকার জন্য নাকেমুখে গামছা বেঁধে মেশিনে অ্যাসবেস্টস বোর্ড কাটেন।
আবদুস সালাম, অ্যাসবেস্টস চুলা তৈরির কারখানার শ্রমিক

ইয়ার্ড ছাড়িয়ে লোকালয়ে অ্যাসবেস্টস
উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের গামারিতল এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘেঁষে অ্যাসবেস্টস বোর্ডে বড় দুটি স্তূপ রাখা হয়েছে। সঙ্গেই চুলার কারখানা। ভাঙাচোরা অ্যাসবেস্টস পড়ে রয়েছে যত্রতত্র।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে দোকানটিতে গেলে পাতলা গড়নের এক লোক কথা বলার জন্য এগিয়ে আসেন। নিজেকে দোকানমালিক বলে দাবি করেন মোশতাক নামের ওই ব্যক্তি। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় বোর্ডগুলো কিসের তৈরি? জবাবে তিনি বলেন, এটি অ্যালবেস্টস বোর্ড। জাহাজের ফার্নিচারের সঙ্গে এগুলো আসে। তিনি মাদামবিবিরহাট এলাকার অ্যাসবেস্টস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিনে চুলা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছেন। অ্যাসবেস্টস বিষাক্ত কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুবই বিষাক্ত। তাই গামছা দিয়ে নাকমুখ বেঁধে অ্যাসবেস্টস কাটেন। উন্মুক্ত স্থানে স্তূপ করে রেখেছেন কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, দোকানটি ছোট। তাই বাধ্য হয়ে রেখেছেন তিনি।
দোকানটির এক কিলোমিটার দক্ষিণে কাশেম জুট মিল এলাকায় আরেকটি অ্যাসবেস্টস চুলা তৈরির কারখানায় ঢুকেই দেখা মিলল শ্রমিক আবদুস সালামের। মাথায় টুপি, পরনে টি-শার্ট ও লুঙ্গি পরে চুলা বানাচ্ছিলেন তিনি। নাকমুখ ঢাকা ছিল না। ক্রেতা সেজে চুলার দাম জিজ্ঞেস করতেই আবদুস সালাম ডাবল চুলার দাম হাঁকলেন ৩৫০ টাকা। এখন অ্যালবেস্টসের দাম বাড়তি জানিয়ে বলেন, বেশি কিনলে মালিক দাম কিছুটা কমিয়ে রাখবেন।
অ্যাসবেস্টস শরীরের জন্য ক্ষতি কি না, জানতে চাইলে আবদুস সালাম বলেন, শরীরের জন্য ক্ষতি বলে শুনেছেন তিনি। পাউডার না ঢোকার জন্য নাকেমুখে গামছা বেঁধে মেশিনে অ্যাসবেস্টস বোর্ড কাটেন।
এরপর ভাটিয়ারী রেলস্টেশন রোড এলাকা থেকে সলিমপুর বাংলাবাজার পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার মহাসড়কের উভয় পাশে যে কয়টি ফার্নিচার তৈরির কারখানা রয়েছে, তার বেশির ভাগ কারখানাতে অ্যাসবেস্টস বোর্ড দেখা যায়। এর মধ্যে বিএমএ স্কুলগেট, টোব্যাকো গেট, সলিমপুর সিডিএ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফৌজদারহাট, বাংলাবাজার এলাকায় মহাসড়কের ধারে, দোকানের সামনের নালায় অ্যাসবেস্টসের টুকরা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যখন দ্রুতগতিতে গাড়ি যায়, তখন এসব এলাকায় এ পদার্থ বাতাসে উড়তে থাকে। ফলে সড়কে চলাচলকারী যাত্রী-পথচারী সবার শরীরে অ্যাসবেস্টস তন্তু ঢুকছে।
সলিমপুর সিডিএ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশ ঘেঁষে সড়কের ওপর ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অ্যাসেবেস্টস ‍টুকরা। আসবাব দোকানি শামসুল আলম বলেন, অ্যাসবেস্টস ক্ষতিকারক পদার্থ শুনে এক বছর ধরে এ পদার্থ দিয়ে আসবাব বানান না।
বাংলাবাজারের একটি ফার্নিচার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, অ্যাসবেস্টস কাটার যন্ত্রটি বন্ধ। ফার্নিচার বিক্রয়কর্মী অ্যাসবেস্টস দিয়ে বানানো বিভিন্ন রকমের ফার্নিচার দেখালেন। সর্বোচ্চ দাম ছয় হাজার টাকার একটি খাট দেখালেন, যেটি নিম্নমানের কাঠ দিয়ে করতে গেলে অন্তত ২০ হাজার টাকার বেশি লাগবে বলে ওই কর্মচারী জানান।
ওই দোকানের মালিক মো. সালাউদ্দিন বলেন, তাঁরা ফ্লাইবোর্ড, অ্যাসবেস্টস বোর্ড ও কাঠ দিয়ে ফার্নিচার বানান। তাঁরা খুচরা বিক্রি করেন না।
এ রকম ঠিক কত স্থানে অ্যাসবেস্টস প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তার সঠিক হিসাব শিল্প মন্ত্রণালয় কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে নেই।
কথা হয় অ্যাসবেস্টসে আক্রান্ত জাহাজভাঙাশ্রমিক আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি জাহাজভাঙা কারখানার শ্রমিকদের অ্যাসবেস্টস সম্পর্কে সচেতন করতে অ্যাসবেস্টস ভিকটিম রাইটস নেটওয়ার্ক নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
উপজেলার প্রায় সব অ্যাসবেস্টসের দোকানে ঘুরেছেন দাবি করে আবুল কালাম বলেন, সীতাকুণ্ডে অ্যাসবেস্টস বোর্ড বিক্রির পাইকারি দোকান, ফার্নিচার ও চুলা তৈরির শতাধিক কারখানা রয়েছে। সরকারের কোনো নজরদারি না থাকায় যত্রতত্র গড়ে উঠেছে এসব দোকান। ফলে নিজের অজান্তেই আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। তাঁরা জাহাজভাঙাশ্রমিকদের সচেতন করছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখন মহাসড়কের পাশ থাকা অ্যাসবেস্টস দোকান থেকে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের সচেতন করার চেয়ে দোকানগুলো সুরক্ষিত স্থানে স্থানান্তর করা উচিত।
বিএসবিআরএর সভাপতি মোহাম্মদ আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়কের ধারে অ্যাসবেস্টস দিয়ে আসবাব ও চুলা তৈরির বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি দাবি করেন, বর্তমানে যে জাহাজগুলো ভাঙার জন্য আনা হচ্ছে, সেগুলো ১৯৯০ সালের পরে তৈরি। এ জাহাজে অ্যাসবেস্টস নেই। ফলে অ্যাসবেস্টস ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়েছে অ্যাসবেস্টস। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের গামারিতল এলাকায়।
প্রথম আলো

আক্রান্ত ৩৩ শতাংশ শ্রমিক
২০১৭ সালে ওশির গবেষণায় উঠে আসে জাহাজভাঙা কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ শ্রমিক এ রোগে আক্রান্ত। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন জাহাজভাঙা কারখানার ৩০০ জন শ্রমিকের ওপর তিনটি ধাপে গবেষণা চালায়। যাঁরা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জাহাজভাঙা কারখানায় কাজ করছেন, যাঁরা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন কিংবা যাঁরা ধূমপায়ী। তার মধ্যে প্রথম ধাপের ১০১ জন শ্রমিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ৩৩ জনের ফুসফুসে অ্যাসবেস্টসের উপস্থিতি পান তাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ওই সব শ্রমিকের ফুসফুস বিভিন্ন মাত্রায় অকার্যকর হিসেবে সনদ দেওয়া হয়। গত তিন বছরে এ রোগে পাঁচজন শ্রমিক মারা গেছেন।
ওশি জানায়, অ্যাসবেস্টস খনিজ পদার্থ আগুন ও পানিতে ধ্বংস হয় না। অ্যাসবেস্টসিস রোগের বাহ্যিক কোনো লক্ষণ নেই। আক্রান্ত শ্রমিকের দীর্ঘদিন পর শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। এমনকি ফুসফুসে ক্যানসারও হতে পারে।
ওশির প্রকল্প কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ কবির ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা এ রোগে আক্রান্ত, তাঁদের ফুসফুসের কার্যকারিতা কমছে। এর সঠিক চিকিৎসার ব্যাপারে কিছু না বললেও বেঁচে থাকার জন্য নেবুলাইজেশন করতে হবে।
আক্রান্ত শ্রমিকদের অবস্থা কী
অ্যাসবেস্টসে আক্রান্ত হয়ে ফুসফুসের ৬০ শতাংশ কাজ করছে না শ্রমিক মো. শফির। তিনি ৩০ বছর ধরে উপজেলার বিভিন্ন জাহাজভাঙা কারখানায় কাজ করেছেন কাটারম্যান হিসেবে। থাকেন উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ফুলতলা এলাকায় ভাড়া বাসায়। এখন আর কাজ করতে পারেন না। একটু কাজ করলেই বুকে ব্যথা শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তখনই তাঁকে নেবুলাইজেশন করতে হয়। ইনহেলার গ্রহণ করতে হয়। মাসে তাঁর সাড়ে চার হাজার টাকার ওষুধ লাগে। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম এই ব্যক্তির সন্তান বলতে পাঁচ মেয়ে।
মো. শফি প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজের ফার্নিচার ও পাইপ ফিটিং খোলার সময় হাতুড়ি দিয়ে অনেক সময় অ্যাসবেস্টস ভাঙতে হয়। তখন ধুলার মতো উড়ত অ্যাসবেস্টস। নাক দিয়ে ঢুকে এখন ফুসফুসে জমা হয়েছে। এটা নাকি আর বের করার কোনো পথ নেই। অ্যাসবেস্টস যে এত ক্ষতিকর, তা তিনি জানতেন না। বুকে ব্যথা ওঠার পর তাঁর এত অসহ্য লাগে, যেন তিনি আর বাঁচবেন না। অ্যাসবেস্টসে আক্রান্ত হয়ে মালিক কিংবা সরকারের সহযোগিতা পাননি।
অপর শ্রমিক উত্তর সলিমপুরের বাসিন্দা আবুল কালাম জানান, তাঁরও ফুসফুসের ২০ শতাংশ অকার্যকর। তাঁরও মৃদু শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা হয়। দেখা দেয় শারীরিক নানা জটিলতা। তিনি এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। ফলে তাঁকে কাজে নিতে চান না অনেক কারখানার ব্যবস্থাপকেরা। তবু মাঝেমধ্যে কাজ করতে যান।
যখন তাঁরা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তাঁদের কাশি হচ্ছিল।
এরপর কথা হয় অ্যাসবেস্টসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া শ্রমিক আবু নুরের স্ত্রী শাহানা চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁরা থাকেন সোনাইছড়ি ইউনিয়নের পাক্কা মসজিদ এলাকায়। শাহানা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী অ্যাসবেস্টসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর তিনি জানতেন না। দুই বছর আগে যখন তাঁর ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে, তখন তিনি জানতে পারেন। এরপর নানা হাসপাতালে চিকিৎসা করেও তাঁকে বাঁচাতে পারেননি। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
অ্যাসবেস্টসিস ভিকটিম রাইটস নেটওয়ার্কের সভাপতি আবুল কালাম মনে করেন, জাহাজ ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান, সরকার ও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের অ্যাসবেস্টসিসে আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের আক্রান্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আক্রান্ত শ্রমিকদের চিকিৎসা ও ভরণপোষণেরও দায়িত্ব নিতে হবে। অ্যাসবেস্টস আমদানি, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধের জোর দাবি জানান তিনি।
নেই ডাম্পিং ব্যবস্থা

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কারখানামালিকদের কথা অনুযায়ী নির্ধারিত ঘরগুলোতে অ্যাসবেস্টস যদি রাখাও হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত অ্যাসবেস্টস কোথায় যায়? আসলে এ অ্যাসবেস্টস দিয়ে গ্রামকে গ্রাম ক্যানসার ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সীতাকুণ্ডে ভাঙার জন্য আনা জাহাজের অ্যাসবেস্টস ধ্বংস করা কিংবা সুরক্ষিত রাখার কোনো ডাম্পিং স্টেশন নেই। ফলে অ্যাসবেস্টস যাচ্ছে খোলাবাজারে।
এনজিও সংস্থা ইপসার প্রোগ্রাম কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী শাহীন বলেন, গ্রিন ইয়ার্ড পিএইচপি ও দুয়েকটি কারখানা ছাড়া অন্য কোনো কারখানায় সঠিক উপায়ে অ্যাসবেস্টস অবমুক্ত করার দক্ষতা ও উপকরণ নেই। অ্যাসবেস্টস সংরক্ষণের যেসব অবকাঠামো রয়েছে, তা অকার্যকর। এগুলো মূলত আইওয়াশ। অ্যাসবেস্টস চেনা ও যথাযথ উপায়ে অবমুক্ত করতে শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ জরুরি।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কারখানামালিকদের কথা অনুযায়ী নির্ধারিত ঘরগুলোতে অ্যাসবেস্টস যদি রাখাও হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত অ্যাসবেস্টস কোথায় যায়? আসলে এ অ্যাসবেস্টস দিয়ে গ্রামকে গ্রাম ক্যানসার ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এটাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, এসব দেখার দায়িত্ব কারখানামালিকদের না থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, পিএইচপি, কেএসআরএমসহ হাতে গোনা দুয়েকটি বড় কারখানা অ্যাসবেস্টসকে সিমেন্টের ক্যাপসুল তৈরি করে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছে। তবে বেশির ভাগ কারখানা নীতিমালা মানছে না।
দপ্তরটির চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ জোনের বিপজ্জনক বর্জ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করনে ট্রিটমেন্ট স্টোরেজ অ্যান্ড ডিসপোজাল ফেসিলিটি (টিএফডিএফ) স্থাপনের কাজ শুরু করেছে সরকার, যেখানে জাহাজভাঙাশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পের অ্যাসবেস্টসসহ নানা বর্জ্য সংরক্ষণ, ধ্বংস করা হবে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়া) মো. জাফর উল্লাহ্ বলেন, টিএফডিএফ বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। এ জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। অ্যাসবেস্টসসহ নানা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় করোনাকালে একটি গাইডলাইন দিয়েছেন তিনি।
বিএসবিআরএ সভাপতি মো. আবু তাহের বলেন, টিএফডিএফ স্থাপনের জন্য সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ে জায়গা খুঁজছেন তাঁরা। জায়গা পেলে সেখানে সব ধরনের বর্জ্য ধ্বংস করা হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান ও জরিমানা
পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন কারখানায় বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করলেও মহাসড়কের কাছে উন্মুক্ত স্থানে অ্যাসবেস্টস প্রক্রিয়াজাত আসবাব কারখানাগুলোতে কোনো অভিযান চালায়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার পরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, রাস্তার পাশে অ্যাসবেস্টস ছড়িয়ে থাকার বিষয়টি তাঁদের জানা নেই। খুব শিগগির এসব স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হবে।