ঈদ আসে না পাটকলশ্রমিকদের জীবনে

খুলনার খালিশপুরে ক্রিসেন্ট জুট মিল গেটে কিছু কাগজপত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. জামশেদ ওরফে মোতালেব সেখ। মিল বন্ধের পর তিনি নড়াইলের গ্রামে ফিরেছেন।
ছবি: প্রথম আলো

সোহরাব হোসেন (৫৬) খালিশপুরের প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলে পাট বিভাগের স্থায়ী শ্রমিক ছিলেন। মিল বন্ধ হওয়ার পর মাদারীপুর সদরের কুন্তিপাড়া গ্রামে ফিরে যান। সেখানে বেকার জীবন কাটানোর একপর্যায়ে মাস ছয়েক আগে আবারও ফিরে এসেছেন। মিলগেটে ভাড়া নিয়ে ছোট্ট একটা দোকান খুলেছেন। তবে দোকানে ব্যবসা নেই। হাতে টাকা না থাকায় ঈদ নিয়ে কোনো প্রস্তুতিও নেই। তবে মন খারাপের অনুভূতি আছে।

সোহরাব হোসেন বলছিলেন, ‘কোনো শ্রমিক এক সপ্তাহ কাজ না করলে পরের সপ্তাহে চাল কেনার টাকা থাকত না। সেখানে দেড় বছর বসে খেয়েছি। পরিবারের ভরণপোষণ মেটাতে পারছি না বলে আবার ফিরেছি। ছয় মাস দোকানদারি করে সাত হাজার টাকা লস। পরিবার-পরিজন দেশের বাড়িতেই আছে। ঈদে কাউকে কিছু দিতে পারিনি। দেখলে মায়া লাগবে, তাই ঈদে বাড়িতেও যাব না।’

মিল বন্ধের পর সোহরাব হোসেন ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। বাকি টাকা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে পাওয়ার কথা ছিল। গত দুই বছরে তা পাননি। তবে দিন দুয়েক আগে সঞ্চয়পত্রের জন্য খুদে বার্তা পেয়েছেন। ঈদের পর সঞ্চয়পত্রের হিসাব খুলতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি। এসবের বাইরেও ২০১৯ সালের ছয় সপ্তাহের মজুরি, ২০২০ সালের পবিত্র ঈদুল আজহার বোনাস এবং অন্য খাতের কিছু মজুরি এখনো বকেয়া রয়েছে সোহরাবের।

সম্প্রতি প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলের সামনে কথা হয় সোহরাব হোসেনের সঙ্গে। কথা বলার সময় সেখানে একে একে জড়ো হন আরও ২০ শ্রমিক। কেউ মিলে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন, কেউ বদলি হিসেবে। তাঁরাও একই সুরে জানালেন তাঁদের অভাব-অনটনের কথা।

তাঁদের মধ্যে জাকির হোসেন নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘বেকারত্ব আর মানসিক অশান্তিতে দুর্বিষহ জীবন কাটছে অধিকাংশ শ্রমিক পরিবারের। ঈদের আগে আমরা পাওনা টাকার অপেক্ষায় থাকি। ঈদের বেতন-বোনাস নিয়ে বসে আছেন অফিসাররা। শ্রমিকদের ঈদ কীভাবে হবে, সেটা তাঁদের মাথায় থাকে না। ঈদের আগে মিলগেটে দেখবেন শ্রমিকদের ঘোরাঘুরি বেড়ে গেছে।’

আলাপে আলাপে জানা গেল, মিল বন্ধের পর অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। তবে যখন মিল বন্ধের নোটিশ টাঙানো হয়, তখনো শ্রমিকেরা জানতেন পাটকলগুলো আবার চালু হবে। সে আশায় অনেক শ্রমিক কলোনি এলাকা ছেড়ে দিলেও খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। তবে মিল কখনো চালু হবে কি না, সেটি এখন আর তাঁরা বুঝতে পারছেন না।

২৫ বছর ধরে মিলে শ্রমিকের কাজ করা মফিজুর রহমান এখন একটি পরিবহনের চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তবে পবিত্র রমজান শুরুর কিছুদিন পর থেকে যাত্রী কম হওয়ায় মালিক বাস রাস্তায় নামাচ্ছেন না। মফিজুর এখন আবারও বেকার হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ঈদের জন্য কিছুই কিনিনি। সেমাই-চিনি কী দিয়ে কিনব, সে চিন্তায় আছি। কাজও বন্ধ হয়ে রয়েছে। আবার মিলের ছয় সপ্তাহের বকেয়া মজুরি আর বোনাস পাইনি। শুধু শুনে আসছি—এই দিয়ে দেবে। কিন্তু দেয় তো না।’

অতীতের স্মৃতিচারণা করে মফিজুর বলেন, আগে বৃহস্পতিবার মিলের সামনে দাঁড়ানোর জায়গা থাকত না। ওই দিন বিল পাওয়া যেত। প্রত্যেক বৃহস্পতিবারই যেন ছিল ঈদের দিন। কলোনিতে এখন কেউ থাকেন না। টাকা নিতে হলে ঘর ছাড়তে হবে বলে কলোনি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কলোনি ভেঙে ফেলেছে। অনেকে বাড়ি চলে গেছেন। অনেকে ভাড়া বাড়িতে উঠছেন। ঈদের এ সময় বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অনেকে ঠিকমতো খেতে পারছেন না।

বিষণ্ন মুখে বদলি শ্রমিক মো. আসলাম ফকির বলেন, ‘ঈদ আর আমাদের হয় না। সব জিনিসের দাম বাড়তি। যা ইনকাম, তার চেয়ে বেশি খরচ। এমনিই ধারদেনা করে চলা লাগছে। মিল বন্ধের পর এখনো কোনো টাকা চোখেই দেখিনি। দু–তিন শিফটে কাজ করতাম। বকেয়া ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা পাব। অন্তত টাকাটা পেলে পোশাক-আশাক কিনতে পারতাম। এখন তো ঈদের দিনও কী খাব, তার ঠিক নেই।’

ক্রিসেন্ট জুট মিলের গেটে কিছু কাগজপত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. জামশেদ। মিল বন্ধের পর তিনি নড়াইলের গ্রামে ফিরেছেন। সঞ্চয়পত্রের টাকা ও বকেয়া এখনো পাননি। সঞ্চয়পত্রের হিসাব খোলার জন্য কয়েক দিন ধরে খুলনা শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন। জামশেদ বলেন, ‘কষ্টেই আছি। আমাদের আবার ঈদ কী? সঞ্চয়পত্রের টাকা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। ঈদের পর আবার আসতে বলেছে।’

এদিকে ঈদের আগে বকেয়ার দাবিতে কিছুদিন ধরে পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ, সমন্বয়ক পাটকল রক্ষায় শ্রমিক কৃষক ছাত্র জনতা ঐক্য পরিষদ এবং কারাখানা কমিটির পক্ষ থেকে মানববন্ধন, সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।

খুলনার খালিশপুরে বন্ধ একটি জুট মিল
ছবি: প্রথম আলো

এ ব্যাপারে খুলনা পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ আহ্বায়ক কুদরত-ই খুদা প্রথম আলোকে বলেন, খুলনাঞ্চলের নয়টি পাটকলে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে প্রায় ৪৫ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। স্থায়ী শ্রমিকেরা কেউ কেউ কিছু টাকা পেলেও অস্থায়ী শ্রমিকেরা কোনো টাকা পাননি। তাঁরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অথচ যাঁরা এই মিলে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন, তাঁরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। একটা কল্যাণকর রাষ্ট্রে এ ধরনের বৈষম্য কোনোভাবেই কাম্য নয়।