উজানের ঢলে ৩৪ ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দী

তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বেড়ে লালমনিরহাটে পঞ্চম দফার বন্যায় জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। আদিতমারীর মহিষখোঁচা ইউনিয়নের বারোঘরিয়া এলাকা।২৪ সেপ্টেম্বরপ্রথম আলো

বৃষ্টিসহ ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমারসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬টি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে ধরলা, নীলফামারীতে তিস্তা ও লালমনিরহাটে এই দুই নদীর পানিই বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে তিন জেলায় ৩৪টি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

লালমনিরহাট: আজ বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্ট নদীর বিপৎসীমার রেখা ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার। আর ধরলার পানি সদর উপজেলার মোগলহাটের শিমুলবাড়ি পয়েন্টে ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ পয়েন্টে বিপৎসীমার রেখা ৩১ দশমিক শূন্য ৯ সেন্টিমিটার।

জেলার বন্যাকবলিত সাতটি ইউনিয়ন হলো সদর উপজেলার তিস্তা নদীপারের রাজপুর, গোকুন্ডা এবং খুনিয়াগাছ, ধরলাপারের মোগলহাট ও কুলাঘাট। আর আদিতমারী উপজেলায় তিস্তারপারের মহিষখোঁচা ও পলাশী।

পানি ওঠায় অনেকে বাড়িঘর ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। মহিষখোঁচা ইউনিয়নের গোবর্ধন গ্রাম থেকে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে তোলা
প্রথম আলো

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম কুমার রায় ও আদিতমারীর ইউএনও মো. মনসুর উদ্দিন জানান, দুই উপজেলাতেই সাড়ে তিন হাজার করে পরিবার পানিবন্দী। তাদের জন্য ত্রাণসহায়তা হিসেবে জেলা প্রশাসন থেকে ২৫ মেট্রিক টন করে জিআর চাল ও ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তবে সেটা এখন কমের দিকেই। আর ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে আরও বাড়ছে।

জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর বলেন, পঞ্চম দফার বন্যায় জেলার সব কটি বন্যাপ্রবণ ইউনিয়ন তিস্তা ও ধরলা নদীর পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণসহায়তা হিসেবে ১১৫ মেট্রিক টন জিআর চাল ও ৮১০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আরও বরাদ্দ দেওয়া হবে।  

কুড়িগ্রাম: ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে কুড়িগ্রামের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। আর ধরলার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, আজ ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এর ফলে ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম সদর ও উলিপুর উপজেলায় ২০টি ইউনিয়নে নদ-নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান প্রধান জানান, ধরলার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় এবং সব কটি নদ–নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় ৪ হাজার ৬১৯ হেক্টর জমির রোপা আমন ও ১৯৩ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে।

ফুলবাড়ী উপজেলার বড় ভিটা ইউনিয়নের চর মেখলী খন্দকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাকা ভবনের দুটি কক্ষ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

নদ-নদীতে তীব্র স্রোতে সদর উপজেলার যাত্রাপুর, ভোগডাঙ্গা, ঘোগাদহ, হোলখানা; নাগেশ্বরী উপজেলার কালীগঞ্জ, নুনখাওয়া, বেরুবাড়ী; ফুলবাড়ী উপজেলার চর মেকলী; ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ইসলামপুর; চিলমারী উপজেলার চর বজরা; রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ও ঘড়িয়ালডাঙ্গাসহ জেলার ১৬টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব জায়গায় আটটি জলকপাট ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এরই মধ্যে ফুলবাড়ী উপজেলার বড় ভিটা ইউনিয়নের চর মেখলী খন্দকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাকা ভবনের দুটি কক্ষ ও পাকা মসজিদ, শতাধিক পরিবারের বসতভিটা ও কয়েক শ একর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক পরিবার বসতভিটা হারিয়ে সড়ক, বাজার ও বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, উজানে ভারী বৃষ্টির কারণে জেলার সব কটি নদ–নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নীলফামারী: জেলার দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় তা আরও ৮ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল।

এর ফলে ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী ও গয়াবাড়ি ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি চরাঞ্চলের ৫ হাজার ৯০০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়নুল হক বলেন, তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউনিয়নের পূর্ব খড়িবাড়ি, টাপুরচর, পাগলপাড়া, পাগলির বাজার, চরখড়িবাড়ি, উত্তর খড়িবাড়ির প্রায় এক হাজার ৭০০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানির তোড়ে চরখড়িবাড়ি গ্রামে অবস্থিত স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাঁধটি রক্ষায় এলাকাবাসী চেষ্টা চালাচ্ছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যারাজের সব কটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রানী রায় প্রথম আলোকে বলেন, বন্যায় ডিমলা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৫ হাজার ৯০০ পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। পানি এখন কমছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য ৪৭ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী]