উদ্বাস্তু হওয়ার শঙ্কায় তাঁরা

জমি হুকুম–দখলের সিন্ধান্ত বাতিল চান কৃষকেরা। তাঁদের সংগঠিত করতে এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার খুলনার দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা ইউনিয়নে।
ছবি: প্রথম আলো

কুয়াশার মধ্যেই সকাল সকাল খেতে ধান কাটতে নেমেছিলেন খুলনার দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা এলাকার কৃষক সমরেশ গাইন (৬২)। তাঁর খেতে এবার ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু সমরেশ গাইনের আশঙ্কা, আগামী বছর হয়তো খেতে ধানই চাষ করতে পারবেন না তিনি।
কারণটা সমরেশ গাইন নিজেই জানালেন। বাণীশান্তা বিলে তাঁরসহ অন্য কৃষকদের প্রায় তিন শ একর জমি হুকুমদখল করা হবে। সেখানে মোংলা বন্দর চ্যানেলের অধিক গভীরতার জন্য পশুর নদ খনন করে মাটি ও বালু ফেলা হবে।
সমরেশ গাইনের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে কথা হয় বাণীশান্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুদেব কুমার রায়ের সঙ্গে। তাঁর কাছে মোংলা বন্দর চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিং প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর থেকে কৃষিজমিতে মাটি ফেলার জন্য জমি হুকুমদখলের অনাপত্তির বিষয়ে চিঠি এসেছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, জেটিতে অধিক ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানোর প্রয়োজনীয় গভীরতা অর্জনের জন্য মোংলা বন্দর চ্যানেলের ইনার বারে খনন প্রকল্পটি চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি একনেকের সভায় অনুমোদন করা হয়। প্রকল্পের আওতায় পশুর নদ থেকে প্রায় ২১৬ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালু উত্তোলন করা হবে। মোংলা বন্দরের পর্যাপ্ত জমি না থাকায় এই মাটি, বালু দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন খাস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে ফেলতে হবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে এই প্রকল্প শুরু হলে শেষ হতে প্রায় দুই বছর সময় লাগবে। মাটি ও বালু ফেলার জন্য বাণীশান্তা ইউনিয়নের ৩০০ এবং মোংলার চিলা ও চাঁদপাই ইউনিয়নের ৭০০ একর জমির প্রয়োজন হবে। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, জমিগুলো সাময়িকভাবে ব্যবহারের জন্য মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
তবে খুলনা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শাহানাজ পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সম্প্রতি সভা করেছে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেখানে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন আলোচনা হয়েছে। তবে কাগজে-কলমে এখনো কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি।
বাণীশান্তা ইউনিয়নের কৃষকেরা বলছেন, এই জমিগুলোই তাঁদের জীবিকার উৎস। দীর্ঘদিন বালু, মাটি ফেলে রাখায় জমিগুলো উর্বরতা হারাবে। সাময়িক ব্যবহারের ক্ষতিপূরণ পেলেও ফসল উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির শিকার হতে হবে তাঁদের।
পশুর নদের পারেই বাণীশান্তা ইউনিয়ন। গত বৃহস্পতিবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিলে চলছে ধান কাটার ধুম। এলাকার চায়ের দোকানগুলোতেও জমি হুকুমদখলের আলোচনা। সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এলাকায় মাইকিং চলছিল। স্থানীয় লোকজন জানান, কৃষকদের সংগঠিত করতে নিয়মিতভাবে এলাকায় মিছিল ও মানববন্ধন করা হচ্ছে। কৃষকদের দাবি একটাই, জমি হুকুমদখল করে বালু ফেলতে দেওয়া যাবে না।

বিলের একটি জমির মালিক গৌতম রায় বলছিলেন, এই বিলের কৃষিজমি খুবই উর্বর। বন্দর কর্তৃপক্ষ এক একর জমির জন্য বছরে ২০ হাজার টাকা ক্ষতি পূরণ দেবে। কিন্তু এক একর জমি থেকে কৃষকেরা বছরে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার বেশি আয় করেন। জমি হুকুমদখল করা হলে অনেক পরিবার উদ্বাস্তু হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জমির মালিক বলেন, এই এলাকার বাসিন্দারা বন্দরের সুবিধা পান না। তাই তাঁরা বন্দরের প্রয়োজনে নিজেদের ক্ষতি মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের ধারণা, একবার বন্দর কর্তৃপক্ষ জমি ব্যবহার করলে পরে আরও জমি ব্যবহার করতে চাইবে। বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীও তাঁদের কৃষিজমির দিকে নজর দেবে।
বাণীশান্তা ইউনিয়ন ও দাকোপ উপজেলা ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জমি হুকুমদখল করা হলে স্থানীয় কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে জনরোষের সৃষ্টি হবে কি না, তা জানতে চেয়ে এরই মধ্যে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে চিঠি দিয়েছেন জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা।
এই চিঠির বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুদেব কুমার রায় বলেন, জমি হুকুমদখল করা হলে অসংখ্য পরিবার ভূমিহীন হয়ে যাবে। অনেকে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হবেন। এই হুকুমদখলের সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য কৃষকেরা প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছেন। তাঁরা জমি রক্ষায় আইনি প্রক্রিয়ার দিকেও যাবেন।