ঋণ নেন ৫ হাজার, সুদ দেন ২ লাখের বেশি, এরপরও মহাজন বেচে দিলেন দম্পতির নবজাতক

সন্তানহারা শ্রমিক রানী বেগম
ছবি: প্রথম আলো

৫ হাজার টাকার ঋণের জন্য প্রতি মাসে ৪ হাজার টাকা সুদ গুনতে হবে। ঋণ শোধ না হলে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়বে সেই টাকা। অর্থাৎ মাসিক ৮০ শতাংশ সুদহারে ঋণ নিতে হবে। সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারলে সুদসহ পুরো টাকার জন্য প্রতি মাসে আবার ৮০ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। এমন শর্তে দুই বছর আগে লাকি বেগম নামের এক নারীর কাছে থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন রানী আক্তারের স্বামী নির্মাণশ্রমিক হান্নান চৌকিদার। আর তাতেই সুদের জালে আটকা পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন রানী ও হান্নান।

রানী আক্তারের অভিযোগ, দুই বছর আগে লাকির কাছ থেকে স্বামীর নেওয়া মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ঋণের সুদ হিসাবে এ পর্যন্ত ২ লাখ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। তারপরও আরও ১ লাখ ৩ হাজার টাকা পাওনা বলে দাবি করছেন লাকি। টাকা শোধ করতে না পারায় ১ বছর আগে জন্ম নেওয়া তাঁর একদিন বয়সী নবজাতককে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ঋণ শোধ না হলে মারধরের ভয়ে রানীকে রেখে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে পালিয়েছেন তাঁর স্বামী।

এমন ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আলীগঞ্জ পিডব্লিউডি কলোনিতে। স্থানীয়দের অভিযোগ মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে অন্তত পাঁচ বছর ধরে এ ধরনের সুদের কারবার চালাচ্ছে একটি পরিবার। তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মো. আজাদ ও হজরত আলী নামের দুজন চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী। আর তাতেই সর্বস্বান্ত হয়েছে কলোনির নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ।

শনিবার দুপুরে কলোনিতে দাঁড়িয়ে সে কথাই বলছিলেন রানী বেগম। ভাগ্যবদলের আশায় বছর চারেক আগে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বাদুরতলা থেকে স্বামীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ এসেছিলেন তিনি। ইট ভাঙার শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। তারপর থেকে কলোনির সুদের মহাজন মো. আজাদের বাড়িতেই ভাড়া থাকেন তাঁরা। আজাদের ছোট মেয়ে লাকি বেগমের কাছ থেকেই ঋণ নিয়েছিলেন রানীর স্বামী হান্নান।

সুদের জালে আটকা পড়ে নিজের সন্তানকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে কাঁদেন রানী। তিনি বলেন, দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাঁকে সর্বস্বান্ত করে দেওয়া হয়েছে। রানী বলেন, ‘গর্ভে সন্তান আসার পর ওরে পেটে নিয়াই কাজ করছি। সেই সন্তান যখন জন্ম নিল তখন আমারে না জানাইয়া একদিন বয়সী ছেলেরে বেইচা দিসে। কোথায় কার কাছে বিক্রি করসে আমি তা জানি না। আমি যখন ছেলে বেচার কারণ জানতে চাইলাম তখন লাকি বলল সুদের টেকা না দেওয়ায় ছেলেটারে বেইচা দিসে। তা ছাড়া বাচ্চা থাকলে আমার কাজ করতে সমস্যা। আর ঠিকঠাক কাজ না করা গেলে সুদের বাকি টাকা ফেরত দিতে সমস্যা হইব।’

রানীর অভিযোগ, তিনি পড়াশোনা জানেন না। শহরে পরিচিত কেউ নেই। এই সুযোগেই লাকি বেগম ও তার স্বামী হজরত আলী ঋণ বাবদ তাঁর কাছ থেকে কাগজে সই রেখেছে। সেই কাগজ দেখিয়ে থানায় মামলা করা যাবে, পালিয়ে গেলেও পুলিশ দিয়ে ধরে আনা হবে এমন ভয় দেখানো হয়েছে তাঁকে। ফলে সন্তান বিক্রির বিষয়ে জানাতে তিনি পুলিশের কাছে যাননি। উল্টো ইট ভেঙে যে আয় হয়েছে তা দিয়ে ঋণ শোধের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দিনের পর দিন ঋণ কেবল বেড়েছে। টাকা শোধ করতে না পেরে আয়ার কাজ করেছেন লাকি বেগমের বাড়িতে।

কেবল রানী নয়, কলোনির এমন বেশ কিছু পরিবার পাওয়া গেছে যারা সুদের মহাজন মো. আজাদ, তাঁর মেয়ের জামাই হজরত আলী ও মেয়ে লাকি বেগমের ঋণের জালে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ঋণ শোধ করতে না পারলে মারধরের শিকার হয়েছেন এমনকি মামলার আসামি পর্যন্ত হয়েছেন। এই কলোনিতে মূলত দিনমজুর, রিকশাচালকসহ নিম্ন আয়ের লোকজন থাকেন। ফলে অন্যায়ের শিকার হয়েও অভিযোগ দেওয়ার ‘সাহস’ তাঁরা পান না।

শনিবার সরেজমিন কলোনিতে গেলে দিনমজুর ইমামুল, ইউনুস মিয়া, চা দোকানদার বাবুল মিয়া, বৃদ্ধা রুবিনা বেগমসহ অন্তত পনেরো জন মানুষ ঋণ শোধ করতে না পারায় তাঁদের নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। দিনমজুর ইমামুল বলেন, বছরখানেক আগে মাসে চার হাজার টাকা সুদে তিনিও পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। তারপর দিনমজুরির কাজ করে অন্তত ১ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। দাবি করা হচ্ছে তাঁর কাছে আরও ১ লাখ টাকা পাওনা। সে টাকা দিতে রাজি না হলে আজাদ ও হজরত আলীরা তাঁকে মারধর করে কাগজে সই নিয়েছে।

মো. সোহাগ নামে কলোনির এক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুদের টাকার জন্য সন্তান বিক্রির মতো ঘটনা ঘটলেও এসব আমাদের জানা ছিল না। সম্প্রতি একটি ঝগড়ার ঘটনায় বিষয়টি সামনে আসে। এই পরিবার চড়া সুদে ঋণ দেয়, ঋণ শোধ না করলে মারধর করে সে খবর আমরা জানতাম। কিন্তু আজাদ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী স্মৃতি মিলনায়তনে আর তাঁর মেয়ের জামাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কাজ করে বলে এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ তাঁদের কিছু বলতে ভয় পায়।’

অভিযোগের বিষয়ে লাকি আক্তারের বাবা মো. আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কোনো সুদের কারবার করেন না। এগুলো তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তবে তাঁর মেয়ে লাকি বেগম দিনমজুর রানী বেগমকে সুদে টাকা দিয়েছেন বলে স্বীকার করেন তিনি। তিনি জানান, বাচ্চা বিক্রি করে সুদের টাকা আদায়ের বিষয়টি তাঁর জানা নেই।

সরকারি এই দুই প্রতিষ্ঠানে তাঁরা কীসের কাজ করেন জানতে চাইলে আজাদ বলেন, তিনি সোহরাওয়ার্দী স্মৃতি মিলনায়তনের পাহারাদার আর মেয়ের জামাই হজরত আলী প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন।
এসব ঘটনায় সম্প্রতি ফতুল্লা থানায় বেশ কিছু অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের পর থেকেই লাকি বেগম ও তাঁর স্বামী হজরত আলী পলাতক।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, শিশু বিক্রির অভিযোগের ভিত্তিতে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। শিশুটিকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। অন্যান্য অভিযোগগুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।