ঋণের জালে সারা বছর

পদ্মাপাড়ের অধিকাংশ জেলের জীবন কেটে যায় ঋণ নেওয়া আর শোধ করার মধ্য দিয়ে। জাল কেনা, নৌকা মেরামতের জন্যও ঋণ করতে হয়।

রাতভর পদ্মায় ভেসে মাছ ধরার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সঙ্গে নেন জেলেরা। গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী নগরের হাদির মোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সকালে শহর ও গ্রামের মানুষ যখন ঘুম থেকে জাগেন, রাজশাহীর পদ্মাপাড়ের নাইমুল (৪৪) ও তাঁর ছেলে মাইনুল ইসলাম (১৬) নদী থেকে নৌকায় জাল-দড়ি, মাছ নিয়ে তীরে ফেরেন। সে মাছ তাঁরা বাজারে বিক্রি করেন, পরিবারের জন্য খাবার কেনেন আর আয়ের বেশির ভাগ টাকাই জমিয়ে রাখেন সপ্তাহ বা মাসের শেষে কিস্তি পরিশোধের জন্য।

এর আগে সারা রাত জেগে নাইমুল আর মাইনুল পদ্মায় ভেসে যেভাবে মাছ ধরেন, সে দৃশ্যের মিল পাওয়া যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের এক বর্ণনার সঙ্গে। ‘সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলেনৌকার আলো ওগুলি। সমস্ত রাত্রি আলোগুলি এমনিভাবে নদীবক্ষের রহস্যময় ম্লান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সংকেতের মত সঞ্চালিত হয়।’

সম্প্রতি রাজশাহী শহরের হাদির মোড়ে পদ্মার পাড়ে গিয়ে নদীতে নৌকা ভাসিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায় নাইমুলদের। গত কয়েক দিন গোদাগাড়ীর রেলবাজার, পবার নবডাঙ্গা, বাঘার কিশোরপুর ঘুরেও কথা হয় বেশ কয়েকজন জেলের সঙ্গে, যাঁদের ঋণের টাকা শোধ করতেই সারা বছর পদ্মায় নৌকা ভাসাতে হয়। যে সময়টাতে নদীতে বেশি মাছ মেলে না বা নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জাল ছিঁড়ে যায়, সে সময়টাতেই বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নেন জেলেরা। কেউ আবার অন্য কাজের জন্য নেওয়া ঋণ শোধ করতেও মাছ ধরতে পদ্মায় নামেন।

বছরের এই সময়ে পদ্মায় বেশি মাছ মিলছে না। এর ওপর চলছে লকডাউন। জেলেদের বর্তমান অবস্থা জানতে ২০ মে নগরের হাদির মোড়ের পাশে পদ্মার তীরে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা পাড়ে এক সারি অস্থায়ী বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির সামনেই মাছ ধরার সরঞ্জাম। সেখানে বসে ছিলেন আনিসুর রহমান (৪০)। তাঁর স্থায়ী বাড়ি নওগাঁয়। ঋণ পরিশোধের ভয়ে তিন কন্যাসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে এসেছেন। এখন পদ্মায় মাছ ধরছেন। পাশেই বসেছিলেন মুক্তার আলী (৩০)। তাঁর বাড়িও নওগাঁয়। ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে হরেক মালের ব্যবসা করতেন। করোনার মধ্যে ব্যবসা বন্ধ। কিস্তি শোধ করতে পদ্মায় নেমেছেন মাছ ধরতে। প্রতিদিন ২৫০–৩০০ টাকা আয় না করলে তাঁর সংসার চলে না।

বাতাসের গতিবেগ স্বাভাবিক না থাকায় নদী থেকে জাল নিয়ে হাদির মোড়ের দিকে আসেন জেলে বাবু মণ্ডল (৪৫)। তিনি বলেন, জাল কেনার জন্য ৪০ হাজার টাকা ঋণ করেছেন। সপ্তাহে এক হাজার টাকার কিস্তি। সঙ্গে ৪০ টাকা সঞ্চয় দিতে হয়। তাই পেটের জন্য না হলেও কিস্তির জন্য পদ্মায় নামতে হয়।

২১ মে সকালে পবা উপজেলার নবগঙ্গা এলাকায় পদ্মায় মাছ ধরছিলেন অন্তত ১০ জন জেলে। তাঁদের মধ্যে দুজন কিশোরও ছিল। সবচেয়ে প্রবীণ ইনতাজুল হক (৬০) বলেন, সারা রাত জাল ফেলে আধা কেজি চিংড়ি মেলে। অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে রাত তিনটা থেকে তাঁকে সহযোগিতা করে।

জেলার পশ্চিম দিকে গোদাগাড়ী দিয়ে পদ্মা নদী ঢুকেছে। উপজেলার রেলবাজারে প্রায় ৫০০ জেলে পরিবারের বাস। ২৩ মে সকালে ঘরের দরজায় বসে জাল বুনছিলেন জুয়েল আলী (৩২)। তিনি বলেন, সব সময় নদীতে মাছ পাওয়া যায় না। অসময়ে চলার জন্য ঋণ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা পল্লব কুমার সাহা বলেন, রাজশাহীতে পদ্মা নদীতে মাছ ধরেন, এমন জেলের সংখ্যা ৭ হাজার ৫২৭। এ হিসাব পুরোনো। বর্তমানে সংখ্যাটা বেশিও হতে পারে। এর মধ্যে ইলিশশিকারি হিসেবে নিবন্ধিত জেলে ৪ হাজার ৭৪৩ জন। ইলিশ ধরা যখন নিষিদ্ধ থাকে, তখন প্রত্যেককে ২০ কেজি চাল দেওয়া হয়।

জেলেদের জীবনচক্রের একটা বর্ণনা পাওয়া গেল বাঘার কিশোরপুরের হলদারপাড়ার জেলে খোকন হালদারের (৩২) সঙ্গে কথা বলে। তাঁর নিজের ৪০ হাজার টাকার ঋণ। মাসে সাড়ে চার হাজার টাকার কিস্তি। বছরের এই সময়ে মাছ ধরে কিস্তি শোধ করবেন। কিন্তু ভরা মৌসুমে মাছ ধরার জন্য নতুন জাল কিনতে আবারও ঋণ করতে হবে। এভাবে ঋণ শোধের চক্রও বছরজুড়ে চলতেই থাকে।