এক দশক ধরে শিকলে বন্দী সুলতানার জগৎ

শিকলে বাঁধা অবস্থায় সুলতানা বেগম। আজ মঙ্গলবার কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার চর সুভারকুটি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

১৬ বছর বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় সুলতানাকে। সংসার শুরুর পর কোলজুড়ে এক কন্যাও আসে। এর মধ্যেই হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে যায়; এলোমেলো কথা বলা শুরু করেন, অযথা হাসাহাসি করেন, চলে যান এদিক সেদিক। উপায় না পেয়ে পায়ে শেকল পরায় পরিবার।

এরপর কেটে গেছে প্রায় এক দশক। শিকলে বাঁধা সুলতানা বেগমের (২৮) আর মুক্তি মেলেনি। তিনি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের চর সুভারকুটি গ্রামের মোক্তারের হাট এলাকার প্রয়াত মো. ছকমাল হোসেনের মেয়ে।

আজ মঙ্গলবার সকালে সুভারকুটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় সড়কে হাঁটছেন সুলতানা। নাম জানতে চাইলে উত্তরে নাম বলেন, স্বামীর নামও বলেন মেহের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবারটি অতিদরিদ্র। ১৬ বছর বয়সে সুলতানার বিয়ে হয় মেহের জামালের সঙ্গে। তাঁদের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। নাম লাবণী আক্তার। তার বয়স ৯ বছর। বর্তমানে মেয়েকে নিয়ে সুলতানার ঠাঁই হয়েছে দিনমজুর বড় ভাই মো. ফজলুর বাড়িতে।

পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রায় ১০ বছর আগে হঠাৎ কিছুটা মানসিক সমস্যা দেখা দেয় সুলতানার। এলোমেলো কথা বলেন, অযথা হাসাহাসি করেন। বাড়ি থেকে বের হয়ে অনেক দূরে চলে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করে বের করতে হয়। একপর্যায়ে চিকিৎসার জন্য কবিরাজের কাছে যান পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু কোনো কাজ না হয় না। উল্টো সমস্যা বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে পায়ে শিকল দিয়ে রাখা হয়। এ অবস্থায় তাঁর স্বামী মেহের জামাল দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যান। তাঁরও কোনো খোঁজ নেই।

সুলতানার বড় ভাই ফজলু বলেন, ‘আমার মা-বাবা নেই। দিনমজুরি করে চলি। করোনার সময় কাজকাম নাই বললেই চলে। আমরাও সন্তান আছে। নিজে চলতে পারি না। বসতভিটা ছাড়া নিজেদের জমিজমা নেই। তার ওপর পাগলি ছোট বোন ও তার মেয়েটিকে দেখতে হচ্ছে। খাবার জোগাড় করতে পারি না। চিকিৎসা করাই কেমন করে।’

শিকলে বাঁধার কারণ সম্পর্কে ফজলু বলেন, তিনি কাজে গেলে সুলতানা হুটহাট বাড়ি থেকে বের অনেক দূরে চলে যান। কাজ থেকে ফিরে খুঁজে আনতে হয়। বাড়ির নারীরাও কেউ কেউ খুঁজে নিয়ে আসেন। বেশি দূরে গেলে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। বাধ্য হয়ে পায়ে শিকল দিয়ে রাখেন। তবুও বাইরে চলে যান সুলতানা।

হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রিয়াজুল ইসলাম বলেন, পরিবারটি খুব গরিব। তিনি মাঝেমধ্যে সহযোগিতা করেন। ভাতাও করে দিয়েছেন। কোথাও দেখলে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

স্থানীয় সমিলের মালিক মো. বেলাল রহমান বলেন, পরিবারটি খুব গরিব। মেয়েটির সারা দিন পায়ে শিকল বাঁধা থাকে। উন্নত চিকিৎসা পেলে ভালো হতে পারে। কিন্তু চিকিৎসার অভাব, অযত্ন আর অবহেলায় ধীরে আরও মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন সুলতানা।