শরীয়তপুর জেলা যুবলীগের বর্ধিত সভা ঘিরে শহরের পাঁচটি স্থানে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে পথচারীসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে সূত্রপাত হওয়া এই সংঘর্ষ চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। অপর দিকে শহরের পালং বাজারের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে দুপুর সাড়ে ১২টায় দলের বর্ধিত সভা শুরু হয়। এ সভা শেষ হয় বেলা সাড়ে তিনটায়। যুবলীগের পদপ্রত্যাশী নেতারা মহড়া দিয়ে শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে এ সংঘর্ষে জড়ান বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
সংঘর্ষে এক পক্ষে নেতৃত্ব দেন সাংসদ ইকবাল হোসেন অপুর অনুসারী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বাচ্চু ব্যাপারী ও সাংসদের চাচাতো ভাই সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বিল্লাল হোসেন। আরেক পক্ষে নেতৃত্ব দেন পৌর মেয়র পারভেজ রহমান এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সাংসদ বি এম মোজাম্মেল হকের অনুসারী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিক পাহাড়।
পুলিশ জানায়, যুবলীগের বর্ধিত সভা উপলক্ষে পদপ্রত্যাশী নেতারা সমর্থকদের নিয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। প্রায় ২০ হাজার নেতা-কর্মীর দুপুরের খাবারের জন্য রান্নার আয়োজন করা হয়। এমন অবস্থায় বর্ধিত সভা ঘিরে শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কে পালং বাজারের ব্যবসায়ীরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বর্ধিত সভায় যোগ দেওয়ার জন্য পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বাচ্চু ব্যাপারী ও সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বিল্লাল হোসেনের উদ্যোগে ১৫ হাজার কর্মী-সমর্থকের জন্য খিচুড়ি রান্না করা হয়। রাজগঞ্জ ব্রিজ এলাকা, চৌরঙ্গী ও বটতলা এলাকায় তাদের সমর্থকেরা জড়ো হন। আর পৌর মেয়র পারভেজ রহমান ও সিদ্দিক পাহাড়ের সমর্থকেরা জড়ো হন পৌরসভা চত্বরে, আশ্রাফুল উলুম কওমি মাদ্রাসা মাঠে ও বাস টার্মিনাল এলাকায়। সেখানে পাঁচ হাজার মানুষের জন্য খাবার রান্না করা হয়।
আওয়ামী লীগ কার্যালয়টি শহরের পালং বাজারে অবস্থিত। ওই স্থানে বিশৃঙ্খলা এড়াতে পুলিশের পাশাপাশি দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত ছিলেন। বর্ধিত সভা শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। কিন্তু সেটি দুপুর ১২টার দিকে শুরু করা হয়। সভা শেষ হয় বেলা সাড়ে তিনটায় শেষ হয়।
নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশী পারভেজ রহমান, সিদ্দিক পাহাড় ও সাখাওয়াৎ হাওলাদার তাঁদের সমর্থকদের নিয়ে বর্ধিত সভায় আসতে চাইলে বাধা দেন বাচ্চু ব্যাপারী ও দিপু মিয়ার সমর্থকেরা। তখন উত্তর বাজার, বাসস্ট্যান্ড, চৌরঙ্গী, ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে ও মনোহর বাজার মোড়ে সংঘর্ষ হয়। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এ সময় বিভিন্ন স্থানে দুই শতাধিক ককটেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তখন ২০ ব্যক্তি আহত হন। এ সময় সরকারি শিশু পরিবারের শিক্ষক চয়ন বিশ্বাস ও শামীম মিয়াকে মারধর করে আহত করা হয়। তাঁদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ২২টি ফাঁকা গুলি ছুড়েছে।
সারা শহরে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল। যাঁরা অস্ত্র প্রদর্শন করে মিছিল করেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করতে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হবে।
জেলা যুবলীগ সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে সংগঠনের সম্মেলন করা হয়েছিল। দীর্ঘ ১৬ বছরেও আর নতুন কমিটি করা হয়নি। এই ১৬ বছরে জেলা যুবলীগের শীর্ষ পদে থাকা নেতারা আওয়ামী লীগের কমিটিতে চলে গেছেন। কেউ অন্য দলে, দেশের বাইরে ও কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে জোড়াতালি দিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে মঙ্গলবার বর্ধিত সভা ডাকা হয়।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুর সদরের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুটি পক্ষ রয়েছে। একটি পক্ষের নেতৃত্বে আছেন বর্তমান সাংসদ (শরীয়তপুর-১) ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ইকবাল হোসেন। আরেক পক্ষকে নেতৃত্ব দেন সাবেক সাংসদ ও দলের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক। গত সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে বি এম মোজাম্মেল হকের সমর্থকেরা স্থানীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তাঁরা দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেন না।
জেলা যুবলীগের আগামী সম্মেলন ঘিরে তিনটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। একপক্ষে সভাপতি প্রার্থী হিসেবে তৎপরতা শুরু করেছেন শরীয়তপুর পৌরসভার মেয়র পারভেজ রহমান। অন্যপক্ষে সভাপতি পদপ্রত্যাশী রয়েছেন সাংসদ ইকবাল হোসেনের অনুসারী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বাচ্চু ব্যাপারী, সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বিল্লাল হোসেন, শরীয়তপুর সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি তারিকুল ইসলাম। আরেক পক্ষে সভাপতি পদপ্রত্যাশীরা হলেন বি এম মোজাম্মেল হক–সমর্থিত ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিক পাহাড়, সহসভাপতি সাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার। সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন সাংসদের সমর্থক সদর পৌরসভা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহীদ কোতোয়াল, পাভেল মুন্সি এবং বি এম মোজাম্মেল হকের সমর্থিত জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জসিম মাদবর।
যাঁরা বিশৃঙ্খলা করেছেন, তাঁরা যুবলীগের কেউ নন। তাঁদের কাউকে যুবলীগে স্থান দেওয়া হবে না।
সংঘর্ষের বিষয়ে জেলা যুবলীগের সভাপতি এম এম জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, বর্ধিত সভা যেহেতু সাংগঠনিক সভা, তাই জেলার নির্বাহী কমিটি, প্রতিটি উপজেলা কমিটির ৯ জন করে ও সদর পৌরসভার ৯ জন যোগ দিয়েছেন। আর ছয়জন কেন্দ্রীয় নেতা অংশ নিয়েছেন। এর বাইরে কাউকে অনুষ্ঠানে আসতে দেওয়া হয়নি। তিনি লোকমুখে শুনেছেন, অনেকে শোডাউন করার জন্য লোকজন জড়ো করেছেন। তাঁরা বিশৃঙ্খলা করেছেন। এর দায় জেলা যুবলীগ নেবে না।
সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বিল্লাল হোসেন বলেন, যুবলীগের বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে একটি মহল অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছিল। সাংসদের পক্ষে তাঁরা সেটি প্রতিহত করার জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে কর্মীদের জড়ো করেছেন। তাঁদের কেউ সংঘর্ষে জড়াননি।
পৌর মেয়র পারভেজ রহমান বলেন, দীর্ঘদিন পর যুবলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম হচ্ছে। অনেক নেতা-কর্মী অনুষ্ঠানে যাবেন। কিন্তু একটি পক্ষ অনুষ্ঠানে যেতে বাধা সৃষ্টি করেছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হেলাল উদ্দিন বলেন, বর্ধিত সভাটি সুন্দরভাবে করা হয়েছে। সেখানে কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। এর বাইরে যাঁরা বিশৃঙ্খলা করেছেন, তাঁরা যুবলীগের কেউ নন। তাঁদের কাউকে যুবলীগে স্থান দেওয়া হবে না।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নড়িয়া-সদর সার্কেল) মিজানুর রহমান বলেন, সারা শহরে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল। পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। যাঁরা অস্ত্র প্রদর্শন করে মিছিল করেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করতে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হবে।
শরীয়তপুর সদরের পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তার হোসেন বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় কোনো পক্ষ অভিযোগ করেনি। আর কাউকে আটকও করা সম্ভব হয়নি।