এক প্রাচীন পাথরের কথা

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর দেওপাড়ায় নকশাখচিত সেই পাথরখণ্ড
ছবি: প্রথম আলো

আবদুস সামাদের খেতে পাথরটি কতশত বছর যাবৎ পড়ে আছে, কেউ জানে না। তাঁর বাবা দেখেছেন, দাদাও দেখেছেন। পাথরের গায়ে অপরূপ নকশা আঁকা। প্রায় ১০ ফুট লম্বা এই পাথরটিকে খেতের মধ্যে রেখেই তাঁরা চাষবাস করছেন। জায়গাটি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া মৌজার মধ্যে। স্থানীয় লোকজনের মুখে মুখে এলাকাটি এখন ‘কদম শহর’ বলে পরিচিতি পেয়েছে।

ইতিহাসবিদদের মতে, সেন রাজাদের আমলে এই এলাকায় একটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেই সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে এখানকার পথেপ্রান্তরে এখনো এ রকম অনেক প্রত্নবস্তু পড়ে রয়েছে। রয়েছে একটি দিঘি। স্থানীয় লোকজন মাটি খুঁড়তে গিয়ে প্রাচীন দালানের দেয়ালও দেখেছেন। সেন সভ্যতার এই প্রত্নবস্তু সংরক্ষণ করতে পারলে এলাকাটি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা হতে পারে বলে মনে করেন গবেষকেরা।

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের উপপ্রধান সংরক্ষক আবদুল কুদ্দুস জানালেন, ১৯১৭ সালের বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি এখানকার দিঘি উৎখননের সময় একটি গঙ্গামূর্তি পেয়েছিল। সেটি এখন এই জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। ১৮৬৫ সালে রাজশাহীর তৎকালীন কালেক্টরেট স্যার জন থিওফিলাস মেটকাফে শিকারে গিয়ে জঙ্গলবেষ্টিত এই দিঘির পূর্ব পাড় থেকে একটি প্রস্তরখণ্ড উদ্ধার করেন। এতে সংস্কৃত ভাষায় মোট ৩২টি চরণে সেন রাজবংশের পরিচয়, সেন রাজা বিজয় সেনের প্রশস্তিসহ তাঁর কীর্তি, প্রদ্যুন্মেশ্বর মন্দির ও দিঘির বর্ণনা রয়েছে। প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় এটি দেওপাড়া শিলালেখ বা দেওপাড়া অভিলেখ নামে পরিচিত।

গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী তাঁর বরেন্দ্র কৈবর্ত বিদ্রোহ ও রামাবতী নগরী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সেন আমলের সাহিত্যকর্ম ‘দেওপাড়া অভিলেখ’ সম্পর্কে থিওফিলাস মেটকাফে জার্নাল অব দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল পত্রিকায় প্রবন্ধ আকারে প্রথম প্রকাশ করেন। বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির কিউরেটর ননীগোপাল মজুমদার ১৯২৯ সালে এটি সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। সেন রাজাদের সভাকবি উমাপতিধর ছিলেন এই প্রশস্তির রচয়িতা। এর ২৯ নম্বর চরণে বলা হয়েছে, মন্দিরের সম্মুখে রাজা বিজয় সেন একটি বিশাল সরোবর খনন করেন। এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ‘বিজয়নগর’কেই ঐতিহাসিকেরা বিজয় সেনের রাজধানী বলে মনে করেন। সময়টা ১১০০ থেকে ১১৩০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি। সেই হিসাবে প্রত্নবস্তুগুলো যেখানে পড়ে রয়েছে, ধারণা করা হয় প্রদ্যুন্মেশ্বর মন্দিরও সেখানেই ছিল। পাথরগুলো সেই মন্দিরেরই।

সম্প্রতি দেওপাড়ায় গিয়ে দিঘির পূর্ব পাশে আবদুস সামাদের খেতে ১০ ফুট লম্বা পাথরটি পড়ে থাকতে দেখা যায়। পাথরের এক পাশে সুন্দর নকশা। সেখানেই পাওয়া গেল রেজাউল ইসলাম নামে বছর পঁচাশির এক লোককে। পাশের খেতের মালিক তিনি। রেজাউল বললেন, সামাদের বাড়ি পাশের জামদহ গ্রামে। সামাদের বাপ-দাদারাও এভাবেই পাথরটি জমিতে রেখে চাষবাস করছেন। রেজাউল বললেন, তাঁর খেতেও এ রকম একটি পাথর রয়েছে। পাশেই রয়েছে একটি উঁচু ভিটা।

এই ভিটার আশপাশে আরও কয়েকটি পাথর দেখা গেল। রেজাউল বলেন, এলাকার মানুষের বাড়িতেও এ রকম অনেক পাথর রয়েছে। আবদুস সামাদের খেতের পাথরটি একপাশে খানিকটা ভাঙা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দিঘির দক্ষিণ পারের বাসিন্দা সিরাজ উদ্দিন এটি ভেঙে নিয়ে গেছেন। তাঁর বাসায় গিয়ে সত্যিই ভাঙা অংশটি পাওয়া গেল। কিছুদিন আগে সিরাজ উদ্দিন মারা গেছেন। তাঁর ছোট মেয়ে শুকতারা বেগম (৩৮) বললেন, তাঁর মুক্তিযোদ্ধা বাবা সাহসী মানুষ ছিলেন। অনেকেই মনে করে, এই পাথরের কোনো অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। পাথরের গায়ে কিছু লেখা আছে কি না, তা দেখার জন্য তাঁর বাবা লোকজন নিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাথরটিকে ওলটাতে পেরেছিলেন। তাতেই নকশাটা দৃশ্যমান হয়।

ইতিহাসবিদদের মতে, স্থানীয় লোকজনের মুখে মন্দির প্রদ্যুন্মেশ্বর শব্দটিই একপর্যায়ে পদমশহর বা ‘কদম শহর’ হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছে। দেওপাড়া এখন গোদাগাড়ী উপজেলার একটি ইউনিয়ন।

সম্প্রতি সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন রাজশাহীর কবি মোস্তাক রহমান। তিনি বললেন, প্রাচীন সভ্যতার অনেক নিদর্শন এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দিনে দিনে এগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয় এগুলো পর্যটনশিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।