একটি কৃত্রিম পায়ের জন্য প্রতিবন্ধী রিনার আকুতি

বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী রিনা আক্তার ছোটবেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে হারিয়েছেন ডান হাত ও পা। গ্রামে–বাজারে মানুষের কাছে চেয়েচিন্তেই চলে তাঁর জীবন
প্রথম আলো

জন্ম থেকেই কথা বলতে ও শুনতে পারেন না রিনা (২০)। বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী হওয়ায় শিশু বয়সে ট্রেনে কাটা পড়ে ডান হাত ও পা হারাতে হয়েছে তাঁকে। রেললাইনে বসে খেলার দিনগুলোর কথা এখনো জ্বলজ্বলে তাঁর স্মৃতিতে। সেই দুর্ঘটনায় তাঁর রঙিন শৈশব মলিন হয়েছে বটে, কিন্তু জীবন তারও চেয়ে দুর্বিষহ এখন তাঁর টিকে থাকার সংগ্রামে।

এতদিন মানুষের কাছে চেয়েচিন্তেই অন্ন জোগাড় হতো তাঁর। স্থানীয় কিছু মানুষের সহযোগিতায় বছর দেড় আগে পেয়েছিলেন একটি কৃত্রিম পা। সঙ্গে মেরামত করে দেওয়া হয় তাঁর ঘর। দেড় বছর ব্যবহার করার পর তাঁর সেই কৃত্রিম পা নষ্ট হয়ে গেছে। পায়ের অভাবে এখন বাইরে সাহায্যের জন্যও বের হতে পারেন না তিনি। আর ঘর মেরামত করা হলেও অনেক জায়গায় আবার খারাপ হয়ে গেছে।

ঝালকাঠি রাজাপুর উপজেলার গালুয়া ইউনিয়নের পুটিয়াখালী গ্রামে রিনার পৈতৃক বাড়ি। কৃত্রিম পা নষ্ট হওয়ায় হাঁটতে গেলেই পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা হয় তাঁর। কয়েকটি স্থানে কালো দাগও হয়েছে। বাকপ্রতিবন্ধী হওয়ায় নিজের কষ্টের কথা মুখে প্রকাশ করতে পারেন না তিনি।

এতিম রিনা খুব অসহায় অবস্থায় আছেন। তাঁকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভাতা হিসেবে যে কয় টাকা পান, তাতে তাঁদের দুই বোনের খাবার খরচই চলে না।
মো. ফারুক মোল্লা, স্থানীয় ইউপি সদস্য

এলাকাবাসী জানান, ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারান রিনা। ২০১০ সালের কথা সেটি। ২০০৫ সালের দিকে রিনার বাবা মোজাম্মেল হক খুলনা জুট মিলে নিরাপত্তাপ্রহরীর চাকরি করতেন। সেখানেই দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন তিনি। শিশুকালে খুলনার রেললাইনে বসে খেলার সময় বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী হওয়ায় হর্ন শুনতে না পাওয়ায় রিনার ডান হাত ও পায়ের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যায়। সে যাত্রায় কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। বাবার মৃত্যুর পর ২০১১ সালের দিকে দুই মেয়েকে নিয়ে খুলনা থেকে রাজাপুর উপজেলার পুটিয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন তাঁর মা জয়নব বিবি। সেখানে একটি ঝুপড়িঘরে ঠাঁই নিয়ে কোনোমতে জীবন যাপন করছিলেন তাঁরা। মায়ের ভিক্ষা ও প্রতিবেশীদের সাহায্যে চলত তাঁদের সংসার। এক বছরের মাথায় তাঁর মা জয়নব বিবিও মারা যান। এতিম হয়ে যান দুই বোন শিরিন ও রিনা। শিরিন বড়। মা-বাবা হারিয়ে গ্রামের বাড়ির সেই খুপরিঘরেই অর্ধাহারে-অনাহারে তাঁরা বাস করতে থাকেন। ঝড়বৃষ্টি এলেই পানিতে ভরে যেত তাঁদের ছোট্ট ঘরটি। নিরুপায় হয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বৃষ্টিবাদল কাটিয়ে দিতে হতো দুই বোনকে।

বছর দেড় আগে স্থানীয় কলেজছাত্র মেহেদি হাসান প্রতিবন্ধী রিনা আক্তারের এ দুর্দশা দেখে তাঁদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেন। পুটিয়াখালীর স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতা সৈয়দ শাহাদাতকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন। তাঁদের উদ্যোগে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই বোনকে ছয় হাজার টাকা ও দুই বান্ডিল ঢেউটিন দেওয়া হয়। মেরামত করা হয় তাঁদের সেই ঘরটি। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবীরা মিলে নিজেদের অর্থ ও শ্রম দিয়ে রিনার জন্য একটি তহবিল গঠন করেন। সেই তহবিলের অর্থে রিনা একটি কৃত্রিম পা পান। এরপর চলেফিরে খেলেও এখন সেই কৃত্রিম পা নষ্ট হওয়ায় এখন আবার মানবেতর অবস্থায় পড়েছেন তিনি।

রিনাকে ইশারায় কিছু বলতে বললে তিনি পাল্টা ইশারায় মাথা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি ভালো নেই। কৃত্রিম পা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চলাচলে অনেক কষ্টে আছেন। সেই সঙ্গে পায়ের দাগগুলোও দেখান তিনি।

সরেজমিনে রিনাদের বাড়িতে দেখা যায়, কৃত্রিম পায়ের অভাবে কোথাও চলাচল করতে পারছেন না রিনা। পায়ের অভাবে বাইরে সাহায্যের জন্যও বের হতে না পেরে চেয়েচিন্তে খাবারও জোগাড় করতে পারছেন না এই প্রতিবন্ধী তরুণী। থাকার ঘরটিও অনেক জায়গায় আবার খারাপ হয়ে গেছে। রিনাকে ইশারায় কিছু বলতে বললে তিনি পাল্টা ইশারায় মাথা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি ভালো নেই। কৃত্রিম পা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চলাচলে অনেক কষ্টে আছেন। সেই সঙ্গে পায়ের দাগগুলোও দেখান তিনি।

রিনার শুভাকাঙ্ক্ষী কলেজছাত্র মেহেদী হাসান বলেন, একটি কৃত্রিম পায়ের জন্য মেয়েটাকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। গালুয়া ইউপি সদস্য মো. ফারুক মোল্লা বলেন, এতিম রিনা খুব অসহায় অবস্থায় আছেন। তাঁকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভাতা হিসেবে যে কয় টাকা পান, তাতে তাঁদের খাবার খরচই চলে না।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহাগ হাওলাদার বলেন, একটি কৃত্রিম পায়ের অভাবে প্রতিবন্ধী রিনা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ বিষয়ে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা একটি কৃত্রিম পা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তাঁকে সহায়তা করা হবে।