‘একবার ভাবছিলাম যাব না, কিন্তু ঈদ তো প্রতিদিন আসে না’

জরুরি প্রয়োজনে ছেড়ে আসা ফেরিতে গাদাগাদি করে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছেন দক্ষিণাঞ্চগামী মানুষ। আজ সোমবার ১২টার দিকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটেছবি: প্রথম আলো

‘করোনার মধ্যে ভিড় ঠেলে বাড়ি যাইতে ভয় তো একটু করেই। কিন্তু কী আর করার। বাড়িতে আমার মুখ চেয়ে স্ত্রী, ছোট বাচ্চারা দুই দিন ধরে অপেক্ষা করতাছে। একবার ভাবছিলাম বাড়িতে যাব না। কিন্তু ঈদ তো আর প্রতিদিন আসে না।’

ফেরিতে পদ্মা পেরিয়ে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে নামার পর এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি জানাচ্ছিলেন খুলনাগামী যাত্রী ইকবাল হোসেন (৩৫)। আজ সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজার ঘাটে এসে পৌঁছায় যমুনা আইটি-৩৯৫ নামের একটি ডাম্প ফেরি। এতে ইকবাল হোসেনের মতো প্রায় দুই হাজার যাত্রী আর কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ছিল।

ঈদ করতে দেশের বাড়ি পটুয়াখালী যাচ্ছেন পোশাক কারখানার শ্রমিক আবুল বাশার (৪০)। করোনার মধ্যে ভিড় ঠেলে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, ‘ঈদে আগে ভিড় তো লাইগাই থাহে। বাড়ি যাওনের পথে যতই ভিড় থাকুক না ক্যা ঈদে বাড়ি যাইতেই হবে। এবারকা ঈদে বউ, পোলাপাইনের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনছি। ওরা আমার ফিরনের অপেক্ষায় আছে। আমি বাড়ি গেলেই ওগের আনন্দ।’

ঈদে রাজধানী ঢাকা থেকে আসা দক্ষিণাঞ্চলের ঘরমুখী এসব মানুষের বেশির ভাগই শ্রমজীবী
ছবি: প্রথম আলো

ঈদে রাজধানী ঢাকা থেকে আসা দক্ষিণাঞ্চলের ঘরমুখী এসব মানুষের বেশির ভাগই আবুল বাশারের মতো শ্রমজীবী। তারা বছরে দুই ঈদে গ্রামে ফিরে যায় পরিবার ও স্বজনদের কাছে। যদিও করোনা সংক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় এসব মানুষের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। তবে এই আতঙ্কের চেয়ে ঈদে তাদের কাছে বাড়ি ফেরাটাই গুরুত্বপূর্ণ।

গোপালগঞ্জগামী যাত্রী সানোয়ার হাওলাদার বলেন, ‘বছরে ঈদে একবার বাড়ি যাই। আর ঈদ ছাড়া ছুটি দেবে না মালিকে। তাই ঢাকা একা একা থেকে কী করব। বাড়ি যাই, পরিবারের লগে ঈদ করতে।’

আজ সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার আগে আর কোনো ফেরি শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজার ঘাটে আসেনি। তবে বাংলাবাজার ঘাট থেকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ভাসাসৈনিক ডা. গোলাম মওলার নামের ফেরিটি ১২টি অ্যাম্বুলেন্স, ৬টি পণ্যবাহী ট্রাক, ৩০টি মোটরসাইকেল ও দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে শিমুলিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এরপর বেলা ১টার দিকেও বাংলাবাজার ঘাট থেকে ফেরি এনায়েতপুরী ও কুঞ্জলতা অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি ও বেশ কয়েকটি পণ্যবাহী ট্রাক লোড নিয়ে শিমুলিয়া ঘাটে রওনা হয়।

ঢাকা থেকে অনেক কষ্টে বাংলাবাজার পর্যন্ত আসছি। এখানে এসে দেখি উল্টাপাল্টা ভাড়া। ২০০ টাকা বরিশালের ভাড়া মাইক্রোতে চাইতাছে ৬০০ টাকা।
সাব্বির আহমেদ, বরিশালগামী যাত্রী

সরেজমিনে সোমবার বেলা ১১টায় বাংলাবাজার ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকাগামী যাত্রীদের তেমন একটা ভিড় নেই ঘাটে। তবে কয়েক শ পণ্যবাহী ট্রাক ও শতাধিক ছোট গাড়ি পারাপারের অপেক্ষায় ঘাটের সংযোগ সড়কে। শিমুলিয়া থেকে পৌনে ১২টায় বাংলাবাজার ঘাটে আসে ডাম্প ফেরি যমুনা। এই ফেরিতে গাদাগাদি করে আসা প্রায় দুই হাজার যাত্রী ঘাটে নেমেই সিএনজি, মাহিন্দ্র, মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাসে করে ছুটছে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। এদের সবাইকে গুনতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া।

বরিশালগামী যাত্রী সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা থেকে অনেক কষ্টে বাংলাবাজার পর্যন্ত আসছি। এখানে এসে দেখি উল্টাপাল্টা ভাড়া। ২০০ টাকা বরিশালের ভাড়া মাইক্রোতে চাইতাছে ৬০০ টাকা। তা–ও গাদাগাদি করে যেতে হবে। ভাড়া দিতে দিতেই যা টাকা ছিল শেষ।’

মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজার ঘাটে আসা যমুনা আইটি-৩৯৫ নামের ফেরিতে প্রায় দুই হাজার যাত্রী আর কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ছিল।
ছবি: প্রথম আলো

ঘাট কর্তৃপক্ষ বলছে, দিনের বেলায় ফেরি বন্ধ। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স ও লাশবাহী গাড়ি বহনের জন্য উভয় ঘাট থেকে দুই থেকে তিনটি ফেরি ছাড়া হয়। এই ফেরিগুলো ছাড়ার সময় যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে ফেরিতে উঠে পড়ে। অনেকে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়েও উঠে পড়ে ফেরিতে। ঘরমুখী যাত্রীদের ফেরিতে ওঠা কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না।

এ সম্পর্কে বিআইডব্লিউটিসি বাংলাবাজার ফেরিঘাটে ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, দিনের বেলায় ঘাট থেকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো ফেরি ছাড়া হচ্ছে না। আর এই জরুরি ছাড়া ফেরিগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স তোলা হয়। সেই ফাঁকেই যাত্রীরা ফেরিতে উঠে পড়ছে। যাত্রীদের কারণে ফেরিতে অন্য যানবাহনও তোলা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

বাংলাবাজার ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রোববার রাত ৮টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ফেরি চলার পরে প্রায় ৮ ঘণ্টা টোটাল ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। তাই ঘাটে সাড়ে তিন শ পণ্যবাহী ট্রাক ও শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়েছে। দিনের বেলায় ঘাটে অসুস্থ রোগী অ্যাম্বুলেন্স এলে ফেরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে ঘাট কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া সব বন্ধ রয়েছে।