একের পর এক হাওরডুবিতে দিশেহারা কৃষক

উজানে পাহাড়ি ঢলের পানিতে সোনার ফসলডুবিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন হাওরের কৃষকেরা। ছবিটি উপজেলার পাঠার হাওর থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার দাড়াখাল পাঠার হাওরে পাঁচ কেদার (৩০ শতকে ১ কেদার) জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন পাড়ারগাঁও গ্রামের কৃষক আবুল খয়ের। বাড়ির একটি গরু বিক্রি করে তিনি খরচের জোগান দেন। আশা ছিল, খেতের ধান তুলে একটি গাভি কিনবেন। ধান উঠলে তাঁর আর বাইরে থেকে চাল কিনতে হবে না। ঘরের ধান দিয়ে চারটে ভাত খেতে পারবেন। কিন্তু তাঁর সে আশায় গুড়ে বালি।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে কোন্দানালা এলাকায় বাঁধ ভেঙে হাওরটি তলিয়ে গেছে। হাওরের অন্তত তিন হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ করেছিলেন জগন্নাথপুর, শান্তিগঞ্জ ও ছাতক উপজেলার কৃষকেরা। উজানে পাহাড়ি ঢলের পানিতে সোনার ফসলডুবিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন আবুল খয়েরের মতো কৃষকেরা।

কৃষক আবুল খয়ের প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫ কিয়ার জমিই ছিল আমার সম্বল। খেত করেই আমার সংসার চলে। আশা ছিল, খেতের ধান তুলে একটি গাভি কিনব। আর সারা বছর ঘরের ভাত খাব।’

দাড়াখাল পাঠার হাওরে গিয়ে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়কের কোন্দানালা এলাকার ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকছে। উজানের পানিতে সাদা হয়ে গেছে পুরো হাওর। তার মধ্যে সোনালি ধানের ঝিলিক খুঁজে নৌকা দিয়ে কয়েক কৃষক ধান তোলার চেষ্টা করছেন।

ধান তোলার ফাঁকে ছাতক উপজেলার শক্তিরগাঁও গ্রামের কৃষক ইদ্রিস আলী বলেন, আট কেদার জমিতে তিনি ধানের আবাদ করেছিলেন। পানির নিচ থেকে এক কেদার জমির কিছু ধান তুলতে পারলেও বাকি ধান তোলা সম্ভব হয়নি। তাঁর স্ত্রী ফুলমালা বেগম ধান তোলার কাজে স্বামীকে সহযোগিতা করছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মুহূর্তেই হাওরে পানি ঢুকে তাঁদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এ বছর কীভাবে চলবেন, বুঝতে পারছেন না।

ভাতগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আওলাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সুরমা ও মহসিংহ নদের মিলনকেন্দ্র দাড়াখাল পাঠার হাওর। হাওরে জগন্নাথপুর উপজেলার সাদীপুর, পাড়ারগাঁও, মোল্লারগাঁও, বলবল ও বালিকান্দি; ছাতক উপজেলার শক্তিরগাঁও, গুয়াসপুর, গোপালপুর, শ্রীমতপুর, হায়দরপুর, মোড়লপুর ও আসামপুর এবং শান্তিগঞ্জ উপজেলার হলদারকান্দি, শ্রীরামপুর, ইশাকপুর গ্রামের কৃষকদের জমি আছে। বাঁধ ভেঙে হাওরের সব ধান তলিয়ে গেছে।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সীতাংশু রঞ্জন ধর বলেন, হাওরে তিন উপজেলার অন্তত তিন হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এসব ধান রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় কৃষকেরা ক্ষুব্ধ।

হাওর বাঁচাও আন্দোলন জগন্নাথপুর উপজেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছয়টি হাওরের ফসল হারিয়ে উপজেলার কয়েক শ কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। দ্রুত তালিকা করে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো দরকার।

সোনার ধান তলিয়ে গেছে হাওরের পানিতে। নৌকা দিয়ে সেই ফসল তোলার চেষ্টা করছেন কৃষকেরা। ছবিটি পাঠার হাওর থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় কৃষক ও কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে উপজেলার ছয়টি হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে বুধ ও বৃহস্পতিবার—দুই দিনে হাওরের ফসল সব তলিয়ে যায়। হাওরগুলো হলো জগন্নাথপুর উপজেলার মীরপুর ইউনিয়নের হাপাতির হাওর, সৈয়দপুর শাহারপাড়া ইউনিয়নের আহমাদাবাদ বাঁধ হুনদা বিল হাওর, উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের শেওড়ার বন ও রমাপতিপুর পশ্চিমের গলাকাটা হাওর, পাটলী ইউনিয়নের সমসপুর হাওর ও সর্বশেষ দাড়াখালের পাঠার হাওর।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ছোট ছোট ছয়টি হাওরেই কৃষকেরা বোরো আবাদ করেছিলেন। উজানে পাহাড়ি ঢলে হাওরডুবির ঘটনায় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি নিরূপণে কাজ চলছে বলে তিনি জানান।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজেদুল ইসলাম বলেন, ছোট ছোট কয়েকটি হাওরের বাঁধ উপচে সামান্য ক্ষতি হলেও বড় হাওরগুলো এখনো টিকে আছে। তিনি বলেন, দ্রুততার সঙ্গে হাওরের ধান কাটা চলমান। তিন-চার দিনের মধ্যে কৃষকের সব ফসল ঘরে উঠবে।