‘এখন খাল তো কাটি, বাঁধ ভাঙলি পরে দেখা যাবি’

এভাবেই বাঁধের পাশ থেকে মাটি কেটে বিক্রি করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য। মঙ্গলবার বিকেলে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের পূর্বপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

পাবনার ভাঙ্গুড়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশ থেকে মাটি কেটে বিক্রি করছেন এক ইউপি সদস্য। উপজেলার পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের পূর্ব পাড়া গ্রামে এ কাজ করছেন ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হারুনুর রশিদ। এতে বাঁধের পাশে গভীর গর্ত হয়েছে। বৃষ্টি হলেই বাঁধের মাটি ধসে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে বাঁধ।

গভীর গর্তের কারণে বাঁধ ঝুঁকিতে পড়ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ভরসা। এখন খাল তো কাটি, বাঁধ ভাঙলি পরে দেখা যাবি।’

হারুনুর রশিদ জানান, খালটি গ্রামবাসীর। তবে তিনি দেখাশোনা করেন। মাছ চাষের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ার কারণে গর্ত করেছেন। মাটি রাখার জায়গা ছিল না, তাই কিছু মাটি বিক্রি করে দিয়েছেন।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকাটি কৃষিপ্রধান। মাঠের পর মাঠ বিভিন্ন ফসল আবাদ হয়। আগে বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়লেই এসব ফসল ডুবে যেত। ফলে ১৯৮৩ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কৃষকের ফসল রক্ষায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরির উদ্যোগ নেয়। সে অনুযায়ী সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী থেকে ভাঙ্গুড়া উপজেলা হয়ে রাজশাহীর চারঘাট পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি করা হয়। এক দিকের মাটি খনন করে অন্য দিকে তৈরি হয় বাঁধটি। এতে বাঁধের পাশ দিয়ে লম্বা খাল তৈরি হয়। পরে খালপাড়ের বাসিন্দা ও জমিদাতারা সমবায় সমিতি করে পাউবোর কাছ থেকে খালগুলো ইজারা নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন।

ইতিমধ্যে বৃষ্টিতে বাঁধের মাটি ধুয়ে খালে যেতে শুরু করেছে। অতিবৃষ্টি বা বন্যা হলে বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

স্থানীয় লোকজনের দাবি, এই বাঁধের পাশে পাউবোর অধীন প্রায় ১০টি খাল রয়েছে। প্রতিটির আয়তন দুই থেকে পাঁচ একর পর্যন্ত। আগে খালগুলোতে স্থানীয় দরিদ্র মানুষ মাছ চাষ করলেও এখন তা প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। প্রভাবশালীরাই খালগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মাছ চাষ করছেন। এমনই কয়েকটি খাল পারভাঙ্গুড়া ইউপি সদস্য হারুনুর রশিদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি খালগুলোতে মাছ চাষ করেন। চলতি মৌসুমে খালগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় তিনি মাটি কেটে বিক্রি করছেন। প্রায় এক মাস ধরে এই মাটি বিক্রি চলছে। এতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশে বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, নানা ধরনের গাছ রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটিতে। এক পাশে খাল, অন্য পাশে বাড়িঘর। দুটি ভেকু মেশিন খালের দিক থেকেই মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। আর এই মাটি বিক্রিতে বাঁধ ঘেঁষে তৈরি হয়েছে প্রায় ১৫ ফুট গভীর গর্ত। বৃষ্টিতে কিছু স্থানে বাঁধের মাটি ধুয়ে খালে পড়েছে। এতে গর্ত তৈরি হয়েছে বাঁধটিতে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, বাঁধটি তৈরির সময় পরিমাপ বুঝে খাল কাটা হয়েছিল। এতে এত দিন বাঁধের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে এখন বিশাল খাল তৈরি হওয়ায় বাঁধটি হুমকির মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টিতে বাঁধের মাটি ধুয়ে খালে যেতে শুরু করেছে। অতিবৃষ্টি বা বন্যা হলে বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা আক্কাস আলী। তিনি বলেন, কয়েক দিন রাত-দিন মাটি কাটা চলছিল। এখন দিনে কম কাটা হয়। রাতে মাটি কেটে ড্রাম ট্রাকে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের মুখ বন্ধ রাখতে ওই ইউপি সদস্য কিছু ব্যক্তিকে বিনা মূল্যেও মাটি সরবরাহ করেছেন। ফলে কেউ আর তাঁকে কিছু বলছেন না।

আকরাম আলী নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, মাটি কাটার শুরু থেকেই স্থানীয় লোকজন ইউপি সদস্য হারুনুর রশিদকে বহুবার আটকানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি কারও কথা শোনেননি। স্থানীয়ভাবে ওই ইউপি সদস্য বেশ প্রভাবশালী হওয়ায় পরে আর কেউ তাঁকে কিছু বলেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবো পাবনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (ভূমি ও রাজস্ব) মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, কোনো অবস্থাতেই বাঁধের পাশ থেকে মাটি কাটা যাবে না। বিষয়টি জানার পরই দুই কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। মাটি কাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।