এখন শুধুই অপেক্ষা রাসপূর্ণিমার আলোতে ভেসে যাওয়ার

মহা রাস উৎসব উপলক্ষে চলছে নৃত্যের মহড়া। গত সোমবার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাঝেরগাঁওয়ে
ছবি: প্রথম আলো

উৎসবের কোনো আনন্দ ছিল না গেল বছর (২০২০)। সবকিছুই তো থমকে ছিল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে। রাসপূর্ণিমার আলোতে রাতটা ভেসে গেলেও ছিল না উৎসবের প্রাণ। শুধু ধর্মীয় আচারের মধ্যেই সীমিত ছিল সব আয়োজন। এবার সেই বাধা সরেছে। ফিরেছে অনেকটাই খোলা হাওয়ার দিন। দরজায় টোকা পড়েছে শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলা অনুসরণ মহোৎসবের।

আগামী শুক্রবার মহা রাস উৎসব। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর, আদমপুরসহ মণিপুরি অধ্যুষিত গ্রাম ও পাড়ায় এখন সেই উৎসবের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ঘরে ঘরে চলছে রাস উৎসবের প্রস্তুতি। চলছে গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য এবং রাসনৃত্যের মহড়া। এ বছর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের ১৭৯তম মহা রাস উৎসব হবে মাধবপুরের শিববাড়ী ও জোড়া মণ্ডপে। মণিপুরিপাড়ায় এখন চলছে রাসপূর্ণিমার আলোয় ভেসে যাওয়ার জন্য শুধুই অপেক্ষা। অন্যদিকে মীতৈ (মণিপুরি) সম্প্রদায়ের ৩৬তম রাস উৎসব হবে আদমপুর মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে।

উৎসব আয়োজক ও রাসলীলাসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র মণিপুরে প্রথম এই রাসমেলা প্রবর্তন করেছিলেন। মণিপুরের বাইরে ১৮৪২ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাধবপুরে প্রথম শুরু হয়েছিল এই রাসমেলা। সেই ধারাবাহিকতায় শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলা অনুসরণ মহোৎসব এখন মণিপুরি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও এলাকার ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। জগৎপতি কৃষ্ণের ১২ ধরনের রস থেকেই রাস শব্দের উৎপত্তি। এই রাসের সঙ্গে মেলা যুক্ত হয়ে হয়েছে ‘রাসমেলা’। এই ১২টি রসের মধ্যে সাতটি রস হচ্ছে গৌণ। আর পাঁচটি রস হচ্ছে মুখ্য। এই পাঁচটি রসের মধ্যে আবার তিনটি রস হচ্ছে প্রধান। এগুলো হচ্ছে সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। এই তিন রসের উপস্থাপনই রাসলীলায় হয়ে থাকে।

মাধবপুর মণিপুরি মহা রাসলীলা সেবা সংঘ সূত্রে জানা গেছে, শিববাড়ী ও জোড়া মণ্ডপে রাসমেলার দিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শুরু হবে ‘গোষ্ঠলীলা’ বা ‘রাখাল নৃত্য’। কুঞ্জে কুঞ্জে কৃষ্ণের বালকবেলার রাখাল সাজে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বর্ণনা তুলে ধরবে কৃষ্ণরূপী শিশুশিল্পীরা। গোধূলি পর্যন্ত এই রাখাল নৃত্য চলবে। এরপর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং রাত ১১টা থেকে শুরু হবে জোড়া মণ্ডপে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলা অনুসরণ। কৃষ্ণের বাঁশির সুরে উতলা গোপিনীরা মণিপুরি ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের পোশাকে নেচে গেয়ে কৃষ্ণবন্দনা করবেন। ভোর (ব্রাহ্মমুহূর্ত) পর্যন্ত রাসনৃত্য চলবে। মাধবপুর শিববাড়ী ও জোড়া মণ্ডপের উৎসবে এবার প্রধান অতিথি থাকার কথা পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের।

মণিপুরি মহা রাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর কোভিডের কারণে ছোট পরিসরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেই সীমিত ছিল উৎসব। গতবার না হওয়ায় এবার উৎসবের আমেজ অনেক বেশি। ১৫–১৬ দিন আগে থেকে ঘরে ঘরে প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। ছয়টি স্থানে রাখাল ও রাসনৃত্যের মহড়া চলছে।

এদিকে ১৯৮৬ সাল থেকে মীতৈ সম্প্রদায় আদমপুরে রাসমেলার আয়োজন করছে। শিববাড়ী ও জোড়া মণ্ডপে রাসমেলার পাশাপাশি এখন আদমপুরের রাসমেলাও নিজস্ব একটা আদল পেয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। আদমপুরেও ধর্মীয় আচার সকাল ১১টা থেকে গোষ্ঠলীলা ও গভীর রাতে রাসনৃত্য হবে। তবে আদমপুরে এবার করোনার কারণে বাড়তি অনুষ্ঠানের বেশকিছু অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। আলোচনা সভা হবে না। শুধু গোষ্ঠলীলা ও রাসনৃত্যই হবে। তবে এতে উৎসাহ ও আনন্দের কোনো কমতি হচ্ছে না।

আদমপুরের রাসোৎসব ২০২১ উদ্‌যাপনসংশ্লিষ্ট কবি সনাতন হামোম আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে এবার আলোচনা সভা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে যথারীতি ধর্মীয় রীতিনীতির অংশ হিসেবে গোষ্ঠলীলা ও রাসনৃত্য হবে।

রাসমেলাকে কেন্দ্র করে মাধবপুর ও আদমপুর দুটি স্থানেই বসবে শত শত রকমারি পণ্যের দোকান। মণিপুরি তাঁতের তৈরি পোশাক, কুটির শিল্প, নানারকম তৈজসপত্র, শিশুর খেলনা, চুড়ি কিংবা খোঁপার ফুল কী থাকবে না মেলায়। খই-মুড়ির মোয়া, নানা রকমের খাবার, ফুলকপির বড়া, এসব রাসমেলারই অনুষঙ্গ।