এত কম দামে কখনো আম বেচেছেন কি না, মনেই করতে পারেন না তিনি

ফাইল ছবি

উত্তরের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে যত আম উৎপাদিত হয়, এর অর্ধেকই ফজলি আর আশ্বিনা জাতের। আম মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ও পার হতে শুরু করেছে। জুলাইজুড়ে ফজলির দাপট চলবে। সঙ্গে বাজারে আসতে শুরু করেছে আশ্বিনা। জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার আমচাষি আসাদুজ্জামানের আমবাগান ছিল তিন একরের। উপজেলার রানিহাটি এলাকায় এসব বাগান। ফজলি আর আশ্বিনাই সেখানে বেশি। এবার ফজলির মৌসুমের শুরুতে মণপ্রতি এ আম বেচেছেন ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায়। আশ্বিনার মণপ্রতি দর এখন ৮০০ টাকা। স্মরণ করতে পারেন না, এত কম দামে কখনো আম বেচেছেন কি না। গত বছর ফজলি মণপ্রতি ১ হাজার ৩০০ টাকায় বেচা শুরু করেছিলেন। শেষে ২ হাজার ৫০০ টাকা উঠেছিল। আশ্বিনা ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হতো।

আসাদুজ্জামান বললেন, ‘এ পর্যন্ত ৩০০ মণ আম বিক্রি করে ফেলেছি। বেশির ভাগ আম মণপ্রতি হাজারের নিচে বিক্রি করতে হয়েছে। এবার খরচের টাকা উঠবে না। ৮০ ভাগ চাষি লস করবে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আমের মধ্যে যেগুলোর মান খারাপ, সেগুলো জুস কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি হয়। এখন এই বিক্রি চলছে। আসাদুজ্জামান জানান, গত বছর কোম্পানিগুলোর জুসের জন্য আম কিনেছে মণপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। এবার দাম ঠিক করেছে ৩২০ টাকা। আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এবার বাজারেও মার খেলাম। আবার কোম্পানিগুলোও এ সুযোগ নিচ্ছে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই ক্ষুদ্র আমচাষির মতো দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আমচাষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়েছেন। বিশেষ করে আম মৌসুমের এই মাঝামাঝি সময়ের জাতগুলোর ওপর নির্ভর করেন যেসব চাষি, সমস্যাটা তাঁদেরই বেশি। উত্তরের এই জনপদ ছাড়াও ঠাকুরগাঁওয়ের সূর্যপুরি, পার্বত্য তিন জেলায় আম্রপালি, রাংগোয়াই ও বারি-৪ আমের দামে ধস নেমেছে। প্রায় সব জায়গায় গত বছরের চেয়ে অর্ধেক দামে এবার আম বিক্রি করতে হচ্ছে। চলমান লকডাউনে আমের চাহিদা গেছে কমে, তাতেই এ অবস্থা বলে জানান আমচাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। ক্ষুদ্র আমচাষিরা ক্ষতি পোষাতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ফলের জন্য সংরক্ষণাগার দরকার।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো ফজলি ও আশ্বিনার ক্ষেত্রেই শুধু নয়; দেশের যে আম সবচেয়ে বেশি হয়, সেই আম্রপালির বাজারও মন্দা। উত্তরের জেলা নওগাঁয় এ জাতের ফলন বেশি। এবার এখানে ব্যাপক ফলন হয়েছে। এ জেলায় গত বছর সাড়ে তিন হাজার টাকা মণ ছিল। এবার দুই হাজার টাকার বেশি পাননি বলে জানান সাপাহারের আমচাষি সোহেল রানা। তাঁর কথা, খুব ভালো আমও ২ হাজার ২০০ টাকার বেশি দাম মিলছে না।

ফাইল ছবি

ঠাকুরগাঁও জেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সূর্যপুরির নাম। জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকার বড় পলাশপুরের আমবাগানী রহিম মেম্বারের ৫০ একরের বাগান। এখানে বেশি আম্রপালি ও সূর্যপুরি আছে। তিনি জানান, সূর্যপুরি আমের বিক্রি এবার মণপ্রতি ৪০০ টাকা থেকে শুরু হয়েছে। এখন ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। গত বছর এ সময় ১ হাজার ৮০০ টাকা মণ ছিল বলে স্মরণ করতে পারেন। লকডাউনে ব্যাপারীরা আসতে পারছেন না, তাতে সমস্যা প্রবল হয়েছে।

রহিম মেম্বার বলছিলেন, ‘যে রৌদ্র হইছে, আম ফাইটে চৌচির হয়ে গেছে। আমের বয়স বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রাহক নাই। দু-একজন এলেও তাদের কথায় জোর কম। আম নেওয়ার তাগিদ নাই।’

উত্তরবঙ্গসহ সমতল অঞ্চলে এবার আমের ব্যাপক ফলন হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এবার আম হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। যেমন বান্দরবানে এবার গত বছরের চেয়ে অন্তত ১০ হাজার মেট্রিক টন কম আম হয়েছে বলে মনে করছে জেলার কৃষি দপ্তর। কম ফলনের কারণে এবার দাম বেশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পাহাড়ে দাম গতবারের চেয়েও কম। এ কারণে ক্ষতি চাষির চেয়ে বেশি হয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের, যাঁরা বাগান আগাম কিনে রেখেছিলেন। চিম্বুক এলাকার কৃষক তয়ো ম্রো এবার ছয় একরের আমবাগান করেছিলেন। এটি তিনি আগাম বিক্রি করে দেন মং সিং মারমার কাছে। মং সিং জানান, রাংগোয়াই কাঁচা অবস্থায় বেচে কিছু লাভ করেছিলেন। কিন্তু এখন পাকা বিক্রি করতে গিয়ে প্রত্যাশার চেয়ে কেজিপ্রতি অন্তত ১৫ টাকা কম পেয়েছেন। লাভ না, এখন বিনিয়োগ উঠে আসাটাই তাঁর কাছে বড়। বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর বাকি রাংগোয়াই বেচে যদি আসল উঠে আসে, তাতেই অন্তত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবেন।

বিনিয়োগের আসল ফেরত পাওয়ার আশা মং সিং মারমার থাকলেও খাগড়াছড়ির বাগানী সুভাষ চাকমার সেই আশাও নেই। সদর উপজেলার গোয়ামাহাটের এই বাসিন্দার তিন একরের বাগান ছিল। স্থানীয় সমিতির কাছে থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। সার, কীটনাশক বাকিতে নিয়েছিলেন। এবার আম্রপালি ২২ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে কেজিতে বেচতে পেরেছিলেন। এটা গত বছরের চেয়ে কেজিপ্রতি অন্তত ১০ টাকা কম। কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ ১৬ থেকে ১৭ টাকা হয়।

সুভাষ চাকমা বিধিনিষেধের কারণে রাংগোয়াই আম দেরিতে পেড়েছিলেন পরে ভালো দাম পাওয়ার আশায়। তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে। এ আম কেজিপ্রতি ১৬ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমের কম দামের প্রভাব পড়েছে ঢাকার বড় বাজারে।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি ফল ব্যবসায়ীদের সংগঠন কারওয়ান বাজার আদর্শ ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘১৫ দিন ধরে যে দামে আম বিক্রি করলাম, তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য। গত বছরও এ সময় করোনার দাপট ছিল। কিন্তু এত কম দাম হয়নি।’ গতকাল বুধবার মাহবুবুল আলম জানান, আম্রপালি পাইকারি বাজারে ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন তা ৪০ টাকায় উঠেছে। কিন্তু মৌসুমের এ পর্যায়ে গত বছর ৫০ টাকার নিচে আম বেচেননি।

করোনার কারণে বিধিনিষেধের খড়্গ পড়েছে আমচাষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর দাম পড়তির তথ্য জানে। তবে এর কারণে ক্ষতির পরিমাণ কী রকম, তার হিসাব এ অধিদপ্তর করেনি। মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘দাম কিছুটা কমেছে বলে মাঠপর্যায় থেকে জানি। তবে এলাকাভেদে এর ভিন্নতা আছে। সব মিলিয়ে হিসাব করা যায়নি।’
বিধিনিষেধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আমচাষিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান। তিনি মনে করেন, এই সাময়িক সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি আম উৎপাদনের বড় অঞ্চলগুলোয় সংরক্ষণাগার হওয়া জরুরি দরকার। আসাদুজ্জামান বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলে ধানের জমি আমের জমি হয়ে যাচ্ছে। বাগানের আয়তন বাড়লেও এর সংরক্ষণাগারের ব্যবস্থা নেই। এটি করলে চাষির এবার যে দুর্ভোগ হয়েছে, তা হতো না।’

ফাইল ছবি

আমের জন্য প্রচলিত কোল্ড স্টোরেজে কাজ হয় না। এর জন্য ‘ভ্যাপর হিট ট্রিটমেন্ট’ (ভিএইচটি) প্ল্যান্ট বা পরিশোধন কেন্দ্র দরকার হয়। এখানে গরম পানিতে বা বাষ্পে আম শোধন করলে আম বেশি দিন টেকে। আবার আমের ভেতরে থাকা রোগবালাইও দূর হয়। সংরক্ষণের পাশাপাশি দরকার পাল্প কারখানা। রাজশাহী ও নাটোরে একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমন কারখানা আছে। সরকারি স্তরে এমন ব্যবস্থা থাকলে প্রান্তিক কৃষকের জন্য তা উপকারে লাগবে বলে মনে করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম মঞ্জুরে মাওলা।

সম্প্রতি এই ফলের রপ্তানি বাজার বাড়াতে তিনটি জেলায় একটি করে ভিএইচটি স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। জেলা তিনটি হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও সাতক্ষীরা। এতে খরচ হবে ১০০ কোটি টাকা। পুরো টাকাই সরকারের তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে। তিন ভিএইচটি স্থাপনে এখন কেবল জায়গা ঠিক হয়েছে।