‘এবার না খেয়ে মরতি হবে’
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার হরিদাসকাটি গ্রামের কৃষক অসীম ধরের বিল ডুমুরে জমি আছে ১৫ বিঘা। ওই জমি গত বোরো মৌসুমে জলাবদ্ধ ছিল। তবে বিলের ওপরের অংশে পানি কম থাকায় সেচে চার বিঘা জমিতে তিনি বোরো ধানের চাষ করেছিলেন।
ধানের চারা লাগানোর কিছুদিন পর বৃষ্টির পানিতে বিলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে পানিতে তলিয়ে যায় অসীমের ধানখেত। খেত থেকে তিনি কোনো ধান পাননি। ভবদহ অঞ্চলের বিলের ওই জমিতে এবার একটি ধানের চারাও লাগাতে পারেননি তিনি। কারণ, তাঁর সব জমি এখনো পানির নিচে।
অসীম ধর বলেন, ‘এখনো বিলে স্থানভেদে কোমর থেকে বুকসমান জল। তাই কোনো বোরো চাষ করতে পারিনি।’
কেশবপুরের বিল খুকশিয়ায় ৪৫ বিঘা জমি আছে খুলনার ডুমুরিয়ার বরুণা গ্রামের কৃষক আবদুল মান্নান মোল্যার। ওই জমির বেশির ভাগ গত বোরো মৌসুমে জলাবদ্ধ ছিল। বিলের ওপরের অংশে পানি কম থাকায় সেচযন্ত্র দিয়ে সেচে তিনি ১৬ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। এ বছর সেচযন্ত্র দিয়ে সেচে তিনি মাত্র ৮ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। বাকি জমি পানির নিচে থাকায় তিনি ধান চাষ করতে পারেননি।
মান্নান মোল্যা বলেন, ‘এখনো বিলে কোথাও কোমর পরিমাণ আবার কোথাও হাঁটু পরিমাণ পানি রয়েছে। এবার না খেয়ে মরতি হবে।’
অভয়নগরের কোটা গ্রামের কৃষক মিরন আহমেদ তরফদারের বিল কেদারিয়ায় জমি আছে ২০ বিঘা। গত বছর তিনি বিলের ওপরের অংশে সেচযন্ত্র দিয়ে সেচে ওই জমির মধ্যে ৬ বিঘা জমিতে বোরোর চাষ করেছিলেন। ওই জমি সেচে তিনি এবার মাত্র ৪ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিলের কোনো কোনো জায়গায় এখনো কোমরসমান এবং কোনো কোনো জায়গায় বুকসমান পানি রয়েছে। ওই সব জমিতে এবার একটিও ধানের চারা লাগাতে পারিনি।’
অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। পলি পড়ে এ অঞ্চলের মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এসব নদী দিয়ে এ এলাকার পানি নামছে না। প্রতিবছর বৃষ্টিতে এলাকার বিলগুলো প্লাবিত হয়। বিল উপচে পানি ঢোকে বিলসংলগ্ন গ্রামগুলোতে। পানিতে তলিয়ে যায় প্রায় ৪৮৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা। পানিবন্দী হয়ে পড়েন ওই সব এলাকার প্রায় তিন লাখ মানুষ।
ভবদহ অঞ্চলে অন্তত ৫২টি ছোট–বড় বিল আছে। বড় বিলগুলো হলো বিল বোকড়, বিল খুকশিয়া, বিল কেদারিয়া, বিল কপালিয়া, বিল ডুমুর, বিল পায়রা ও দামুখালীর বিল। গত মঙ্গল ও বুধবার বিল বোকড়, বিল কেদারিয়া, বিল ডুমুর, বিল ঝিকরা ও বিল খুকশিয়া সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিলগুলোতে শুধু পানি আর পানি। কোথাও কোনো ধানখেত চোখে পড়েনি। আছে কেবল শাপলা আর আগাছা। তবে বিল কেদারিয়া ও বিল খুকশিয়ার ওপরের অংশে কিছু ধানখেত দেখা গেছে। বিলসংলগ্ন মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী শুকিয়ে সরু খালের মতো হয়ে গেছে। বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), ভবদহ জলাবদ্ধতা নিষ্কাশন কার্যক্রমের আওতায় ভবদহ স্লুইসগেটের (২১ ভেন্ট) ওপর ১৩টি বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র বসিয়ে পানি সেচ দিচ্ছে। স্লুইসগেটের সামনে শ্রী নদীতে চিরচিরে পানি। একটি এক্সকাভেটর দিয়ে নদীর মধ্যে নালা কাটা হচ্ছে। কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় অধিকাংশ সময় সেচযন্ত্রগুলো বন্ধ থাকছে।
স্থানীয় অন্তত ১০ কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পলি জমায় নদীর বুক বিল থেকে কিছুটা উঁচু হয়ে গেছে। ফলে নদী দিয়ে এখন আর পানি সরছে না। বিলের পানি বিলেই থেকে যাচ্ছে। বিলের বেশির ভাগ এলাকায় এখনো হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। চলতি মৌসুমে বোরো চারা রোপণের সময় শেষ। গত বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত বেশি হয়েছে। অভয়নগর ও মনিরামপুরের বিলসংলগ্ন অন্তত ৪০টি গ্রামে পানি ঢোকে। বৃষ্টির পানিতে এসব গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িঘর, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পানিতে প্লাবিত হয়। বাড়িঘর থেকে পানি নেমে গেলেও এলাকার বিলগুলো জলাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। কিছু এলাকায় বিলের ওপরের অংশে সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচে বোরো চাষ করা হয়েছে। তবে তাঁরা জানান, কৃষি অফিসের দেওয়া পরিসংখ্যানের চেয়ে এলাকায় অনেক বেশি জমিতে এবার বোরো চাষ হচ্ছে না।
অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা তিনটির ভবদহ অঞ্চলে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়। তবে জলাবদ্ধতায় এবার মনিরামপুরে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর, অভয়নগরে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর ও কেশবপুরে ১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হচ্ছে না।
অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বিকাশ রায় বলেন, সুন্দলী ইউনিয়নে ১৪টি ছোট–বড় বিল আছে। এর মধ্যে মাত্র ছোট দুটি বিলে সেচে এবার বোরোর আবাদ হয়েছে।
মনিরামপুরের হরিদাসকাটির ইউপি চেয়ারম্যান বিপদ ভঞ্জন পাড়ে জানান, বেশির ভাগ বিল সেচে বোরো ধান চাষ করার মতো অবস্থা ছিল না। তাই সেচে অল্প কিছু জমিতে বোরোর চাষ হয়েছে।
মনিরামপুরের কৃষি কর্মকর্তা হীরক কুমার সরকার জানান, জলাবদ্ধতায় উপজেলার ভবদহ অংশে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়নি।
কেশবপুরের কৃষি কর্মকর্তা মহাদেব চন্দ্র সানা জানান, উপজেলায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হচ্ছে না।
অভয়নগরের কৃষি কর্মকর্তা গোলাম ছামদানী জানান, ভবদহ অংশে বিলের অবস্থা খুবই খারাপ। ওই অংশে এবার ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ সম্ভব হয়নি।
ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির বলেন, সমস্যা সমাধানে টিআরএমের (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট-জোয়ারাধার) কোনোই বিকল্প নেই। কিন্তু টিআরএম না করে বিএডিসি ও পাউবো সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচে জলাবদ্ধতার সমাধান করতে চায়। এটা অবাস্তব ও এতে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হচ্ছে।