এবার পুড়ল এক হাজার ঘর

আগুনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ঘর। শনিবার সকালে গাজীপুরের টঙ্গীর হাজী মাজার বস্তিতেছবি: আল-আমিন

গাজীপুরের টঙ্গীতে লাল মাজার বস্তিতে গত জুনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেই ঘটনার রেশ না কাটতেই শনিবার ভোররাতে আরেকটি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটল। টঙ্গীর ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী মাজার বস্তিতে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে জ্বলা আগুনে প্রায় এক হাজার ঘর পুড়ে গেছে। আগের ঘটনায় পুড়েছিল শতাধিক ঘর।

হাজী মাজার বস্তিতে আগুন লাগার পর কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে চারপাশ। মুহূর্তেই আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ঘুমিয়ে থাকা মানুষেরা কোনোরকম জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। বস্তির প্রতিটি গলি খুবই সরু। কোনোরকমে হাঁটাচলা করা যায়। এর মধ্যেই রাতের অন্ধকারে দৌড়ে বের হতে গিয়ে আহত হন কেউ কেউ। কোনো মালামাল বা জিনিসপত্র বের করতে না পারায় তাঁদের পরনের কাপড়টুকুই এখন শেষ সম্বল।

আগুনে সর্বস্ব হারিয়ে বিলাপ করছেন এক নারী। শনিবার সকালে গাজীপুরের টঙ্গীর হাজী মাজার বস্তিতে
ছবি: আল-আমিন

ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বস্তিটিতে আগুনের সূত্রপাত শনিবার ভোররাত পৌনে চারটার দিকে। বস্তির উত্তর পাশের একটি ঘর থেকে হঠাৎ ধোঁয়া বের হতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন পুরো বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর খবর দিলে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল ছয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন তাঁরা।

টঙ্গী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে খবর পেয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করি। টঙ্গী, উত্তরা, পূর্বাচলসহ কুর্মিটোলার মোট ৯টি ইউনিট একযোগে কাজ করে। সকাল সোয়া ছয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও জানা যায়নি।’

ইকবাল হোসেন বলেন, বস্তিটি খুব ঘনবসতিপূর্ণ। মানুষের ছোটাছুটি, হুড়োহুড়ি, পর্যাপ্ত জায়গা না থাকা, পানির উৎস না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আগুন নেভাতে বেগ পোহাতে হয়।

রাজধানীর আবদুল্লাহপুর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে খানিকটা সামনে এগোলে হাতের বাঁয়ে বস্তিটির অবস্থান। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সেখানে যেতেই দেখা গেল, হাজারো মানুষ হাহাকার করছেন। স্থানীয় কাউন্সিলর ও বাসিন্দাদের মতে, বস্তিটিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো বস্তি প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল। কিন্তু মধ্যরাতের অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব।

দেখা যায়, বস্তিটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পড়ে আছে টিন, কাঠ, ঘরের চালাসহ পুড়ে যাওয়া নানা আসবাব। বাসিন্দারা কেউ কেউ ধ্বংসস্তূপের পাশে বসেই বিলাপ করছেন। তাঁদেরই একজন ফ্রজিনা বেগম। মেয়ে জুয়েনাকে নিয়ে থাকতেন বস্তির ২ নম্বর গলির একটি ঘরে। মানুষের চিৎকারে ঘুম ভাঙতেই দেখেন, ঘরের সামনে আগুন। এরপর পরনে যা ছিল তা নিয়েই কোনোরকমে জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসেন তাঁরা। পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাঁদের ঘর।

ফ্রজিনা বলেন, ‘আমার সব শেষ। আমি গরিব মানুষ, আমি এহন মেয়েডারে নিয়া কই যামু? আল্লাহ এত বড় বিপদ আমারে দিল!’

আরেক বাসিন্দা মো. আক্কেল আলী বলেন, ‘রাতে সবকিছু ঠিকই ছিল। সকাল হতেই সব শেষ। এখন আমাদের কারও ঘর নাই, থাকার জায়গা নাই। জামাকাপড় নাই। এমনকি একটু পানিও নাই। আমরা নিঃস্ব।’

এর মধ্যে সন্ধ্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিটি পরিদর্শনে যান গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ, জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম, মহানগর পুলিশের উপকমিশনার ইলতুৎ মিশ প্রমুখ। এ সময় বাসিন্দাদের কম্বল ও ত্রাণ বিতরণসহ পুনর্বাসনের আশ্বাস দেওয়া হয়।

ভারপ্রাপ্ত মেয়রের বরাত দিয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন বলেন, বস্তিটির প্রায় ১ হাজার ঘরে অন্তত ১০ হাজার মানুষ থাকতেন। চোখের পলকেই সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত মেয়র বস্তিটি পরিদর্শন শেষে তাঁদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছেন।

জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের মধ্যে আমরা ইতিমধ্যে ৩ হাজার কম্বল বিতরণ করেছি। এ ছাড়া সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।’