‘এবার মোক না খেয়া থাকির নাগবে’

বানের পানিতে পচে যাওয়া ধান দেখছেন রংপুরের তারাগঞ্জের দোয়ালীপাড়া গ্রামের কৃষক আশরাফুল ইসলামপ্রথম আলো

‘ভাইজান, মোর সউগ শ্যাষ। মোর সউগ ধান পচি গেইছে, মাছও ভাসি গেইছে। দুর্গন্ধে ধানের খেতোত যাওয়া যায়ছে না। এবার মোক না খেয়া থাকির নাগবে।’ কথাগুলো বলছিলেন রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী গ্রামের বাট্টু মিয়া।
বসতবাড়ির এক কিলোমিটার দক্ষিণে তেরমাইলের মাঠে লাগানো আমন ধানের খেত টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট বন্যায় অন্য কৃষকদের মতো বাট্টু মিয়ার জমিও প্লাবিত হয়েছিল। এতে তাঁর দেড় একর জমির ধানখেত পচে গেছে। ভেসে গেছে দুটি পুকুরের দুই লাখ টাকার মাছ। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।
জগদীশপুর গ্রামের হামিদুল ইসলামও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিজ হাতে মাঠে রোপণ করা দুই একর জমির ধানখেত বানের পানিতে পচে গেছে। তাই তিনিও আল থেকে জমিতে নেমে পচে যাওয়া ধানের চারা তুলে দেখছিলেন আর বলছিলেন, ‘মুই এবার পথোত বসনু। দুই শ শতক জমির ধান, ২০ শতক জমির সবজি বানে খাইছে। একটা পুকুরেরও এক লাখ টাকার মাছ ভাসি গেইছে। খুব দুঃখে আছুং। ছাওয়া-ছোটগুলাক কেমন করি খাওয়াইম। কেমন করি সংসার চালাইম চিন্তা করিবার পাওছি না।’

সম্প্রতি সরেজমিনে উপজেলার ভেড়ভেড়ির, মংলাডুবের, চিকলী, বালাপাড়া, কাঁচনা, তেরমাইল, ডিজিটালের মোড়, দোয়ালীপাড়া, হাজীপুর মাঠসহ আরও কয়েকটি মাঠ ঘুরে হামিদুল ইসলাম ও বাট্টু মিয়ার মতো আরও অর্ধশতাধিক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের অভিন্ন ভাষ্য, বন্যার পানিতে তাঁদের ফসলি জমি, পুকুর প্লাবিত হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
দোয়ালীপাড়া গ্রামের সচ্ছল চাষি আশরাফুল ইসলাম। ধান, সবজি আর মাছ চাষ করে চলে তাঁর ১৫ সদস্যের সংসার। টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢল ভেঙে দিয়েছে তাঁর স্বপ্ন। কথা বলতে বলতে তিনি দোয়ালীপাড়ার মাঠে পচে যাওয়া ধানখেতের আলে বসে পড়েন। সামনের জমিগুলো দেখিয়ে বলেন, বানের পানিতে পচে যাওয়া আমন ধানের খেতগুলো তাঁরই। প্রতিবারের মতো এবারও ৫০ শতক জমিতে সবজি আর ১৫ একরে ধান লাগিয়ে ছিলেন। বন্যার পানিতে তা পচে গেছে।
আলমপুর ইউনিয়নের শেরমস্ত মাঠে কথা হয় ঘোনাপাড়া গ্রামের হায়দার আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভাইজান, মুই কৃষক মানুষ। মাছ চাষ আর ভুইয়োত ধান আবাদ করি যা পাও, তাই খাও। মোক তো কায়ও সাহায্য দেয় না। মুই সাহায্য চাও না খালি এবার আনা ধান আর সবজির বীজ চাও।’

১০ বছর ধরে মাছ চাষ করছেন বামনদীঘি গ্রামের শিক্ষিত যুবক আসাদুজ্জামান। আড়াই একর জমির ওপর এই যুবকের চারটি পুকুর আছে। এসব পুকুরে বিভিন্ন জাতের মাছ ও মাছের পোনা ছিল প্রায় ৬ লাখ টাকার। গত ৩০ সেপ্টেম্বর মাছ বিক্রির তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর আগেই সৃষ্ট বন্যা সব শেষ করে দিয়ে গেছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ রকম বৃষ্টি আমার জীবনেও দেখিনি। চোখের সামনে সব মাছ ভেসে গেছে। ঘর বাড়িতেও পানি উঠেছে। অনেক এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে গিয়েছে।’
জানতে চাইলে সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আজম বলেন, দুই দফা বন্যায় অনেক কৃষকের কোমর ভেঙে গেছে। অনেক কষ্টে চাষ করা তাঁদের মরিচ, বেগুন, শাক, ধান সবই শেষ। মাছও ভেসে গেছে। হাহাকার করছেন তাঁরা। কিন্তু এখনো তাঁদের সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঊর্মি তাবাসুম বলেন, উপজেলায় বন্যায় ২০০ হেক্টর আমন ধানের খেত ও ৮০ হেক্টর সবজি খেত নষ্ট হয়েছে। এতে প্রায় ৫ কোটি ১৭ লাখ ৬ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের দুই হাজার পুকুরের প্রায় ৭ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মৎস্যচাষিদের পুনর্বাসনের জন্য একটি টাকাও বরাদ্দ আসেনি।