এবারও নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ ও সংস্কারকাজ শুরুই হয়নি

নেত্রকোনায় এবারও নির্ধারিত সময়ে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। সময় শেষ হয়ে গেলেও এখনো জরিপ, প্রাক্কলন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনই হয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নীতিমালা অনুযায়ী, জরিপ, প্রাক্কলন ও পিআইসি গঠনের কাজ ৩০ নভেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। আর ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা শেষ করার কথা রয়েছে। কিন্তু জরিপকাজই শেষ হয়নি।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে এমনটি হচ্ছে। তবে নেত্রকোনা পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকতের দাবি, হাওরে এবার পানি ধীরগতিতে নামছে। আর কার্যালয়ের জনবল শূন্য থাকায় একটু সমস্যা হচ্ছে। তিনি আজ শুক্রবার সকালে প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, ‘আর দু–তিন দিনের মধ্যেই জরিপকাজ শেষ হবে। আমি এখন খালিয়াজুরি উপজেলাতে যাচ্ছি। আশা করা যাচ্ছে, আগামী সোমবার থেকে পিআইসি গঠন করা হবে। আর এক সপ্তাহের মধ্যেই বাঁধের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।’

জেলা পাউবো, প্রশাসন ও হাওর অঞ্চলের বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালিয়াজুরি, মোহনগঞ্জ, মদন, কলমাকান্দা, বারহাট্টা উপজেলার হাওরঞ্চলে ৩১০ কিলোমিটার ডুবন্ত (অস্থায়ী) বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে খালিয়াজুরিতে মোট ১৮১ কিলোমিটার ডুবন্ত অস্থায়ী বাঁধ আছে। ওই বাঁধের ওপর স্থানীয় কৃষকদের ৫০ হেক্টরের বেশি জমির রোরো ফসল নির্ভর করে। পাউবোর তত্ত্বাবধানে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত হয়। গত ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জরিপকাজ ও স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে পিআইসি গঠন করে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা শেষ করার কথা। পিআইসি কমিটির সদস্য হবেন পাঁচ থেকে সাতজন। তার আগে গণশুনানি হবে। এসব কমিটি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও মেরামতের কাজ করবে। প্রতিটি প্রকল্পে কাজের বিপরীতে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো জরিপকাজ ও পিআইসি গঠন করা হয়নি। গত বছর জেলায় ১১৩টি পিআইসি গঠন করা হয়েছিল। পিআইসি গঠনে এবার প্রথম পর্যায়ে পাউবো ১০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়। কিন্তু পিআইসি গঠন না হওয়ায় স্থানীয় কৃষকেরা উদ্বিগ্ন রয়েছেন। অনেকের আশঙ্কা, বাঁধের কাজ দেরি হলে ২০১৭ সালের মতো আগাম বন্যা হলে হাওরের শতভাগ ফসল হারাতে হবে।

হাওরে কৃষকদের পক্ষে সোচ্চার জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আনিছুর রহমান বলেন, কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই এখনো জরিপ, প্রাক্কলন ও পিআইসি গঠনের কাজ হয়নি। তবে প্রতিটি প্রকল্প নির্ধারণে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনীয় কোনো প্রকল্প না হয়। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী, রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা লাভবান হতে বিভিন্ন স্থানে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়ে থাকেন। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি পিআইসি গঠনে গণশুনানি করতে হবে। এটি না হলে পিআইসিতে দুর্নীতিবাজেরা ঢুকে পড়ে। দেখা যায়, বারবার প্রভাবশালী একই ব্যক্তিরা কমিটিতে থাকেন। তাঁরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আঁতাত করে ফায়দা লোটেন। তা হতে দেওয়া যাবে না।

হাওরে একসময় ঠিকাদারদের মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হতো। পরে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তা বাতিল করে বাঁধের কাজে পিআইসির মাধ্যমে স্থানীয় কৃষক ও সাধারণ মানুষকে যুক্ত করা হয়। ২০১৭ সালের বন্যায় ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ঠিকাদার ও পিআইসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাও হয়। বাঁধ নির্মাণে নতুন নীতিমালা করে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে সরাসরি যুক্ত করা হয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উপজেলা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক জেলা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
খালিয়াজুরি উপজেলার পুরানহাটি গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত খালিয়াজুরিতে মোট নয়বার বন্যার পানিতে বাঁধ ভেঙে ফসল বিপর্যয় ঘটেছে। এবার আগাম বন্যা হলে বোরো ফসল হুমকির মুখে পড়বে। তাই দ্রুত পিআইসি গঠন করে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন।

উপজেলার বোয়ালি গ্রামের বিধান সরকার জানান, খালিয়াজুরি, মোহনগঞ্জ ও মদন উপজেলা মূলত হাওর এলাকা। জেলায় ছোট–বড় মোট ১৩৪টি হাওরের মধ্যে খালিয়াজুরিতে ৮৯টি হাওর। বোরো ফসলই এখানকার একমাত্র ফসল। এই ফসলের ওপরই নির্ভর করে কৃষকদের সারা বছরের সংসার খরচ, চিকিৎসা, আচার-অনুষ্ঠান ও সন্তানদের পড়ালেখা। ফসলহানি হলে কষ্টের সীমা নেই।

খালিয়াজুরির ইউএনও এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম বলেন, হাওরে পানি থাকায় জরিপ একটু দেরি হয়েছে। পিআইসি গঠনে কাজ চলছে। বাঁধ মেরামতের কাজও দ্রুত শুরু করা হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাবিুর রহমান জানান, জেলায় এবার ১ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে হাওর এলাকায় প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে।

এ ব্যাপারে হাওর বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন জেলা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমান বলেন, ‘স্বচ্ছতার মাধ্যমে পিআইসি গঠনসহ বাঁধের কাজ দ্রুত শুরু করতে পাউবোসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’