ওয়াসা ছাড়তে চান না ফজলুল্লাহ

চট্টগ্রাম ওয়াসা

একে একে পুনর্নিয়োগ পেয়েছেন ছয়বার। সাকল্যে ৯ বছর। এত বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে আছেন এ কে এম ফজলুল্লাহ। ৭৮ বছর বয়সী এই কর্মকর্তাকে আরও তিন বছরের জন্য পুনর্নিয়োগের সুপারিশ করেছে ওয়াসা বোর্ড।

৯ সেপ্টেম্বর ১৩ সদস্যের ওয়াসার বোর্ড সভায় করা এই সুপারিশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কোনো ধরনের অনুসন্ধান কমিটি না করে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে একই ব্যক্তিকে বারবার নিয়োগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব। প্রশ্ন তুলেছে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশও। তাঁদের ভাষ্য, যে বোর্ড এই সুপারিশ করেছে তারা সবাই এমডির আজ্ঞাবহ।

তবে ওয়াসা বোর্ডের ভাষ্য, প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বড় বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। অন্য কেউ এমডি হয়ে এলে কাজের গতি হোঁচট খেতে পারে। এ কারণে ফজলুল্লাহকে পুনর্নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।

তবে বেশির ভাগ প্রকল্পই সময়মতো শুরু হতে পারেনি। বেড়েছে ব্যয়। রয়েছে অনিয়মের অভিযোগও।

ওয়াসা সূত্র জানায়, এমডি হিসেবে এ কে এম ফজলুল্লাহর দায়িত্ব পালনকালে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে অন্তত নয়বার।

এ কে এম ফজলুল্লাহ ২০০৯ সালের ৬ জুলাই চেয়ারম্যান পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। এরপর আরও এক বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। ২০১১ সালে ঢাকা ওয়াসার আদলে চট্টগ্রাম ওয়াসাতেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ তৈরি করা হয়। ওয়াসা বোর্ডও পুনর্গঠন করা হয়। তখন এমডি পদে নিয়োগ পান তৎকালীন চেয়ারম্যান এ কে এম ফজলুল্লাহ। ১৯৪২ সালে জন্ম নেওয়া ফজলুল্লাহ ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে অবসর নেন ১৯৯৮ সালে।

চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিচালিত হয় ১৯৯৬ সালের ওয়াসা অ্যাক্ট অনুযায়ী। এ আইনে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হচ্ছেন এমডি। আইনে এমডি পদে একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার বা কত বছর নিয়োগ পেতে পারেন, সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। ওয়াসা বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমডি পদে নিয়োগ দেয় সরকার।

ওয়াসার যে বোর্ড এ কে এম ফজলুল্লাহকে পুনর্নিয়োগের সুপারিশ করেছে, সে বোর্ডের চেয়ারম্যান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) উপাচার্য মো. জাহাঙ্গীর আলম। অভিযোগ রয়েছে, ‘পছন্দের ব্যক্তি’ জাহাঙ্গীর আলমকে চেয়ারম্যান করতে ফজলুল্লাহর ভূমিকা রয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম ওয়াসার গ্রাহক ছিলেন না। তাঁর স্ত্রীর নামে মিটার সংযোগ ছিল। তড়িঘড়ি করে স্ত্রীর নাম পরিবর্তন করে তাঁকে গ্রাহক করা হয়। এর কিছুদিন পরেই তাঁকে ওয়াসা বোর্ডের ‘গ্রাহক প্রতিনিধি’ করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান জাহাঙ্গীর আলম।

মূল সেবায় গলদ

গত বছর নিরাপদ পানির প্রশিক্ষণে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উগান্ডা যাওয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। চট্টগ্রামে ওয়াসার একটি প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উগান্ডার ‘ন্যাশনাল ওয়াটার অ্যান্ড সুয়ারেজ করপোরেশনকে’ বড় অঙ্কের অর্থও দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার এক শ্রমিকনেতা বলেন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোক নিয়োগ, জেনারেটর, পাম্প কেনা, সংস্কারসহ বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বর্তমান এমডির আমলে। তিনি বলেন, ‘বোর্ড সদস্যরা এমডির পছন্দের লোক। তাঁরা তাঁর পছন্দের বাইরে কোনো কিছু করেন বলে মনে হয় না।’

ওয়াসা সূত্র জানায়, চার বছর আগে এ কে এম ফজলুল্লাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০২০ সালের মধ্যে চট্টগ্রামবাসী দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ পানি পাবেন। কিন্তু তা নিশ্চিত হয়নি। বরং এখনো প্রতিদিন ঘাটতি রয়েছে ৬ কোটি লিটার পানি। নগরে গড়ে পানির চাহিদা ৪২ কোটি লিটার।

ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, এ কে এম ফজলুল্লাহ এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে ২০০৯ সালে চট্টগ্রামে দিনে গড়ে পানির চাহিদা ছিল ৩৭ কোটি লিটার। কিন্তু সংস্থাটির সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ১৪ কোটি লিটার। অর্থাৎ দিনে ঘাটতি ছিল প্রায় ২৩ কোটি লিটার পানি।

চট্টগ্রাম নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ছয়টি ওয়ার্ডে এখনো ওয়াসার সংযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলররা। বিশেষ করে দক্ষিণ পাহাড়তলী, জালালাবাদ, উত্তর পতেঙ্গা, দক্ষিণ পতেঙ্গা ও বাকলিয়া এলাকার কিছু অংশ এখনো ওয়াসার পানি থেকে বঞ্চিত রয়েছে।

এ কে এম ফজলুল্লাহর আমলে হওয়া ‘দুর্নীতি-অনিয়ম’ তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ক্যাবের ভাইস চেয়ারম্যান নাজের হোসাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপদ পানি নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর ভোগান্তি দূর করতে পারেননি বর্তমান এমডি। উল্টো অব্যবস্থাপনার কারণে ওয়াসার প্রকল্পগুলোর ব্যয় যেমন দ্বিগুণ হয়েছে তেমনি সময়ও বাড়ছে। আবার এই এমডি স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে লোক নিয়োগ দিয়েছেন। আবার এমডি পদে নিয়োগ নির্বিঘ্ন করতে পছন্দের ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান বানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগের বিষয়ে দুদক কী পদক্ষেপ নিয়েছে বা আদৌ কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। চট্টগ্রামের বাসিন্দা হাসান আলী নামের এক ব্যক্তির করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার আদালত এ নির্দেশনা দেন।

তবে স্বজনপ্রীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ অস্বীকার করে এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে চট্টগ্রামের মানুষ সপ্তাহে মাত্র দু–তিনবার পানি পেতেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রকল্প ও পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে মানুষজন এখন নিয়মিত পানি পাচ্ছেন। কিছু ঘাটতি রয়েছে, তা–ও ২০২১ সালের মধ্যে দূর হবে। তিনি বলেন, তাঁর বয়সের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করবে।

ব্যয় বাড়ে, কাজ শেষ হয় না

এ কে এম ফজলুল্লাহ ২০১১ সালে এমডি হওয়ার পর চট্টগ্রাম ওয়াসা চারটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করে। এর একটি ‘ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্প’। দক্ষিণ চট্টগ্রামের তিন উপজেলায় পানি সরবরাহের এ প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১ হাজার ৩৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। দেরিতে কাজ শুরু হওয়ায় ব্যয় ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১৯৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন সম্ভাব্য সময় ২০২৩ সাল পর্যন্ত।

২০১১ সালে অনুমোদিত হয় ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও স্যানিটেশন প্রকল্প’। ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা প্রাথমিক ব্যয় নিয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি এখন ১ হাজার ৮৯০ কোটি টাকার। শুরুতে এই প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বর। পরে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু এখনো কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে।

বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন ৪ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের (২য় পর্যায়) কাজ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসা সম্প্রতি নগরের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এখন ঠিকাদার নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

গত বছরের ২৫ মে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় সদস্যরা অভিযোগ করেন, পানির পাইপ বসাতে এক জায়গায় আটবার পর্যন্ত খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়। নিম্নমানের কাজেরও অভিযোগ তোলেন সদস্যরা। তবে এবার কোনো অভিযোগ না তুলে এমডি পদে এ কে এম ফজলুল্লাহকে পুনর্নিয়োগের সুপারিশ করেন বোর্ড সদস্যরা।

বোর্ডের সুপারিশ প্রসঙ্গে এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোর্ড মনে করছে, আমাকে আবার দায়িত্ব দিলে প্রকল্পগুলোর কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক জটিলতা আছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানও জড়িত। সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কাজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়াও আমার জানা আছে। এখন সরকার দায়িত্ব দিলে তা পালন করতে প্রস্তুত আছি।’

বড় বড় প্রকল্প চালু আছে বলে আগের এমডিকে বহাল রাখা কতটুকু যৌক্তিক, এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সনাক-টিআইবির চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এসব প্রকল্প থেকে ওপরের মহলকে কীভাবে সন্তুষ্ট করা যায়, তা বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভালো জানেন। দেশে আধুনিক জ্ঞান-প্রযুক্তিসম্পন্ন এবং অভিজ্ঞ মানুষের অভাব নেই। কিন্তু তাঁরা হয়তো ‘ম্যানেজ’ করার প্রক্রিয়া জানেন না। যাঁরা জানেন তাঁদেরই বারবার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।