কক্সবাজারে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণা প্রশিক্ষণকেন্দ্র

কক্সবাজার উপকূলের মাঠে সমুদ্রের লোনাপানি ধরে রেখে সূর্যতাপে শুকিয়ে উৎপাদন করা হয় লবণ
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে সমুদ্র উপকূলীয় ইউনিয়ন চৌফলদণ্ডী। এখানে অন্তত দুই হাজার একর জমিতে উৎপাদিত হয় ‘সাদা সোনা’খ্যাত লবণ। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চৌফলদণ্ডীর লবণমাঠ পরিদর্শনে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও চাষিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে লবণ গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের আশ্বাস দেন জাতির জনক।

৪৭ বছর পর সেখানে বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণা প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে সেখানকার বিসিক লবণ প্রদর্শনীকেন্দ্রের পাশে ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে গবেষণাকেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণ করা জমি পরিদর্শনে যান শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিসিক চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

শিল্পমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ দিয়ে দেশের জাতীয় চাহিদা পূরণ হচ্ছে। চাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন লবণ উৎপাদন করতে চৌফলদণ্ডীতে বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। কক্সবাজারেই হবে লবণ বোর্ড।

বিসিক কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত চৌফলদণ্ডীতেই লবণ গবেষণা প্রশিক্ষণকেন্দ্রটি স্থাপিত হচ্ছে। তাতে আধুনিক প্রযুক্তিতে বেশি পরিমাণ লবণ উৎপাদনের সুযোগ পাবেন চাষিরা। জেলার প্রায় ৪০ হাজার প্রান্তিক চাষি, এক লাখ শ্রমিকসহ অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

বিসিকের দেওয়া তথ্যমতে, এই মৌসুমে (১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৮ মে পর্যন্ত পাঁচ মাস) কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, রামু, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, ঈদগাহ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৬৩ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৩১ হাজার ৯৩১ মেট্রিক টন। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৩ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। শুরু থেকে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়। কিন্তু মৌসুমের শেষ দিকে এপ্রিল-মে মাসে কয়েক দফা বৃষ্টিপাত হওয়ায় ২০-২৫ দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল। এ কারণে এবার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। বর্তমানে মাঠে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৮০ টাকায়।

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ দিয়েই দেশের জাতীয় চাহিদা পূরণ হচ্ছে। লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চিন্তা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত চৌফলদণ্ডীতে লবণ গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তিকাজে লাগানো গেলে কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।
লবণমাঠে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু

রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকার সময় ১৯৭৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের সফরে কক্সবাজারে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জাহাজ থেকে ঘাটে নেমে লবণমাঠ পরিদর্শন করেন।

রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকার সময় ১৯৭৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের সফরে কক্সবাজারে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন বিকেলে সেনাবাহিনীর ‘বলাকা’ নামে একটি উড়োজাহাজে তিনি কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছান।

১১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বঙ্গবন্ধু নৌবাহিনীর দিশারি নামের একটি জাহাজে চড়ে মহেশখালীর সাগর চ্যানেল পাড়ি দিয়ে চৌফলদণ্ডীর ভারুয়াখালী ঘাটে ছুটে যান। তখন সেখানকার খোলা মাঠে সমুদ্রের লোনাপানি ঢুকিয়ে সূর্যতাপে শুকিয়ে উৎপাদিত হতো লবণ। বঙ্গবন্ধু জাহাজ থেকে ঘাটে নেমে লবণমাঠ পরিদর্শন করেন। নিজ হাতে মাঠের লবণ কুড়িয়ে দেখেন। চাষপদ্ধতি নিয়ে স্থানীয় লবণচাষিদের সঙ্গে কথা বলেন।

লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবং প্রশিক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে সেখানে একটি গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানান তৎকালীন কক্সবাজারের সংসদ সদস্য (বর্তমান কক্সবাজার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান) মোস্তাক আহমদ চৌধুরী ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল করিম।

লবণ প্রস্তুতে কাজ করছেন একজন
ছবি: প্রথম আলো

বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী ফরাশ উদ্দিন, খন্দকার মোশতাক আহমদ, দৈনিক আজাদী সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদ, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক, চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ হোসেন (সাবেক মন্ত্রী), এম এ মান্নান, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার কামাল চৌধুরী, ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, এ কে এম মোজাম্মেল হক, জহিরুল ইসলাম প্রমুখ।

সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাক আহমদ চৌধুরী বলেন, জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কক্সবাজার সফরে এসেছিলেন ১২ বার। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ জরিপ প্রকল্প গ্রহণ, সমুদ্রসৈকতের বালিয়াড়িতে ঝাউবাগান সৃজন, দুর্যোগ মোকাবিলায় উপকূলজুড়ে বনায়ন ও প্রতিরক্ষা বেড়িবাঁধ এবং ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ বঙ্গবন্ধুর আমলে শুরু হয়েছিল। এখন স্মৃতিবিজড়িত চৌফলদণ্ডীতে বঙ্গবন্ধুর নামে লবণ গবেষণা প্রশিক্ষণকেন্দ্র হচ্ছে দেখে খুশি স্থানীয় চাষিরা।