কক্সবাজারের শতবর্ষী বৌদ্ধবিহারে নতুন সংযোজন ‘মুচলিন্ডা’ বুদ্ধমূর্তি

কক্সবাজার শহরের প্রাচীন বৌদ্ধবিহার অগ্গ্যামেধা ক্যাং প্রাঙনে স্থাপিত দৃষ্টিনন্দন ‘মুচলিন্ডা’ বুদ্ধমূর্তি
প্রথম আলো

কক্সবাজার শহরের বৌদ্ধমন্দির সড়কের পূর্ব পাশে শতবর্ষী বৌদ্ধবিহার ‘অগ্গ্যামেধা ক্যাং’। কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি এই বিহারের সামনে তৈরি হয় ছোট একটি জলাধার। সেই জলাধারে সম্প্রতি নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ‘মুচলিন্ডা’ বুদ্ধমূর্তি।

অগ্গ্যামেধা ক্যাং পরিচালনা কমিটির সভাপতি মং ক্য এ রাখাইন প্রথম আলোকে বলেন, অন্য রকম বুদ্ধ মূর্তিটি দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন রাখাইন সম্প্রদায়সহ ভ্রমণে আসা পর্যটকেরা। আগামীকাল বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। এ সময় মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তির দর্শনার্থী আরও বেড়ে যাবে। কক্সবাজার শহরে এ রকম বুদ্ধমূর্তি দ্বিতীয়টি নেই। ২৩ অক্টোবর ভোরবেলায় ১১ জন বৌদ্ধভিক্ষু মূর্তিটির উদ্বোধন করবেন।

প্রবারণা পূর্ণিমা ঘিরে নতুন বুদ্ধমূর্তি দেখতে ভিড় করছেন রাখাইন সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষেরা। জেলার টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, মহেশখালী, ঈদগাঁও, পেকুয়া ও কুতুবদিয়া উপজেলায় বৌদ্ধবিহার আছে ১৫৩টি। এর মধ্যে তিন বৌদ্ধবিহারে আছে ‘মুচলিন্ডা’ বুদ্ধমূর্তি। চতুর্থ মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তিটি স্থাপিত হলো অগ্গ্যামেধা ক্যাংয়ে। মুচলিন্ডাকে রাখাইনরা বলেন ‘মুং জা লিংদা’। অনেকে বলেন ‘নাগা বুদ্ধের মূর্তি’।

কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু প্রথম আলোকে বলেন, সর্পরাজ নাগা আসনে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধমূর্তিকে ‘মুচলিন্ডা’ বলে। জেলার ১৫৩টি বৌদ্ধবিহারের মধ্যে রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার, মহেশখালী বৌদ্ধবিহার ও টেকনাফের খারাংখালী বৌদ্ধবিহার—মাত্র এই তিনটি বিহারে আগে থেকে মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তি রয়েছে।

কক্সবাজার শহরে এ রকম বুদ্ধমূর্তি দ্বিতীয়টি নেই। ২৩ অক্টোবর ভোরবেলায় ১১ জন বৌদ্ধভিক্ষু মূর্তিটির উদ্বোধন করবেন। অগ্গ্যামেধা ক্যাংয়ে মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তিটি স্থাপন করেছেন শহরের ব্যবসায়ী মং হ্লা মি ও তাঁর পরিবারের সাত ভাইবোন।

বৌদ্ধভিক্ষুদের ভাষ্য, ভগবান বুদ্ধ বোধি গাছের নিচে ধ্যান শুরু করার চার সপ্তাহ পরে আকাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সাত দিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। সর্পের রাজা নাগ বা মুচলিন্ডা পৃথিবীর তলদেশ থেকে উত্থিত হয়েছিলেন এবং বুদ্ধকে তাঁর কাণ্ড দিয়ে সুরক্ষিত রেখেছিলেন। ঝড়বৃষ্টি থামলে সর্পরাজ নাগ মুচলিন্ডা মানবরূপ ধারণ করে বুদ্ধের সামনে মাথা নত করেছিলেন। বৌদ্ধে এই লোককাহিনির উপস্থাপনা হচ্ছে নাগ বুদ্ধের মূর্তি বা মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তি।

অগ্গ্যামেধা ক্যাংয়ে মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তিটি স্থাপন করেছেন শহরের ব্যবসায়ী মং হ্লা মি ও তাঁর পরিবারের সাত ভাইবোন। মং হ্লা মি অগ্গামেধা ক্যাং পরিচালনা কমিটির অর্থ সম্পাদক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সাত ভাইবোন মিলে প্রায় ১৩ লাখ টাকা খরচ করে এই মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তিটি তৈরি করে দিয়েছেন। রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় আচার পালনের সুবিধার্থে কয়েক দিন আগে মূর্তির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।

রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মং ছেন হ্লা বলেন, জেলার চতুর্থ মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তিটি স্থাপিত হলো শহরের ৪০০ বছরের পুরোনো প্রাচীন অগ্গামেধা ক্যাং প্রাঙ্গণে। রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মকর্মের পাশাপাশি ভ্রমণে আসা পর্যটকদের উপভোগে নতুন মাত্রা যোগ করবে এই মূর্তি। এটি জেলার সবচেয়ে বড় মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তি।

মূর্তিটি তৈরি করেন শহরের রাখাইন পাড়ার কারিগর জ্য জ্য রাখাইন (৩৩)। তিনি বলেন, যেভাবে গৌতম বুদ্ধ ধ্যানে বসেছিলেন, সেটি ফুটিয়ে তুলতে ইট-বালু–সিমেন্ট দিয়ে ১১ ফুট উচ্চতার এই মূর্তিটি তৈরি করে পানির ওপর স্থাপন করা হয়েছে। মূর্তি তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় তিন মাস।

শহরের বড় বাজার এলাকার রাখাইন তরুণী চঁ য়ে ফ্রু রাখাইন বলেন, আগে মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তি দর্শনের জন্য বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে মহেশখালীর গোরকঘাটায় বৌদ্ধবিহার কিংবা টেকনাফের খারাংখালী বৌদ্ধবিহারে যেতে হতো রাখাইন নর-নারীদের। এখন বাড়ির পাশের বৌদ্ধবিহারে দৃষ্টিনন্দন মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করে দিয়েছেন মং হ্লা মি পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের প্রতি রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ কৃতজ্ঞ। তিনি আরও বলেন, ‘বৌদ্ধধর্মে প্রবারণা হলো আত্মশুদ্ধির ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণের অনুষ্ঠান। কাল বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রবারণা পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমায় আমরা পেলাম বুদ্ধের আরেক মূর্তি। এই মুচলিন্ডা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণ বয়ে আনবে। প্রবারণার অন্ধকার রাতে শত শত ফানুসের আলোয় ঝলমল করবে মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তিও।’