কঠিনতম সময়ে খামারিরা

গোখাদ্যের দাম দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। আর দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধের দাম ও সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়ায় খামারিরা লোকসানে পড়েছেন।

পাবনার বেড়া পৌর এলাকার বনগ্রাম মহল্লার এক খামারে। গত সোমবার
প্রথম আলো

পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় খামারিদের প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ পড়ে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। কিন্তু প্রতি লিটার দুধের দাম পাওয়া যাচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা। খামারিরা বলেন, মাসখানেকের ব্যবধানে গোখাদ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। পাশাপাশি দুধের চাহিদা ও দাম কমার কারণে তাঁদের আয় কমেছে। পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায় দুগ্ধশিল্পে এমন বিপর্যয় এর আগে কখনো আসেনি।

সরেজমিন দুই দিন ধরে বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাখ লাখ টাকা লোকসান ও ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দুধ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন। দুগ্ধশিল্পে এর আগেও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। করোনার সময়ও পরিস্থিতি খারাপ ছিল। কিন্তু এবারের মতো এত খারাপ পরিস্থিতি কখনো আসেনি। এর প্রভাব পড়েছে সাধারণ দুধ ব্যবসায়ীদের ওপর। ফলে খামারিরা গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।

খামারি ও ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার আগে খামারি ও দুধ ব্যবসায়ীরা ভালো লাভ করছিলেন। কিন্তু করোনার কারণে বিধিনিষেধ শুরু হলে এ শিল্পেও বিপর্যয় দেখা দিতে শুরু করে। গত দুই বছরে খামারিরা লোকসান দিলেও করোনা পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু মাসখানেক হলো গোখাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। পাশাপাশি দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধের দাম ও সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়ায় খামারিরা ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন।

বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার খামারি আবদুল মোমিন বলেন, ‘খামারে ১২টি গরু ছিল। সপ্তাহখানেক হলো সব বেইচ্যা দিছি। গোখাদ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় একেকটা গরুতে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ টাকা লস হচ্ছিল। আবার দুধের দামও ঠিকমতো পাচ্ছিলাম না। তাই গরু বেচতে বাধ্য হইছি।’

এদিকে দুগ্ধশিল্পের এ দুরবস্থায় পাবনার অনেক দুধ ব্যবসায়ীসহ দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কিছু প্রতিষ্ঠানও ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সাঁথিয়া উপজেলার আমাইকোলা গ্রামের ইছামতী ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্ট (পিওরা মিল্ক) ও তানিয়া ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্ট (সেইফ মিল্ক) নামের প্রতিষ্ঠান। পিউরা মিল্কের মালিক আবদুর রউফ বলেন, কারখানা চালাতে গিয়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত মাথার ওপর প্রায় ২৫ লাখ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে মাসখানেক হলো কারখানাটি বন্ধ করে দিয়েছেন।

দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান ও খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এই এলাকার ২৫ হাজারেরও বেশি খামারে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ লিটার গরুর দুধ উৎপাদিত হয়। প্রচুর দুধ উৎপাদিত হওয়ায় এই এলাকা থেকে মিল্ক ভিটা, আড়ং দুধ, প্রাণ ডেইরি, ফার্মফ্রেশ, অ্যামোমিল্ক, আফতাব, রংপুর ডেইরিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তরল দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশে খোলাবাজারে বিক্রি করে থাকে।

খামারিরা অভিযোগ করে বলেন, দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই খামারিদের দুধ বিক্রি করার প্রধান ভরসা। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান দুধের সঠিক দাম দিচ্ছে না। এর ওপর চাহিদা কমে যাওয়ার অজুহাতে এসব প্রতিষ্ঠান খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনাও ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে শুরু করেছে। খামারিদের দাবি প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ পড়ে ৪৪ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধের দাম দিচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা।

সরকারি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটার আওতাধীন সাঁথিয়া উপজেলার বোয়ালমারি প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি বেলায়েত হোসেন জানান, তাঁর সমিতিতে খামারি রয়েছেন ১৩২ জন। গরু নিয়ে সমিতির সদস্যরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। সমিতির সদস্যদের লোকসান যাচ্ছে। অথচ দুধের দাম না বেড়ে উল্টো কমে গেছে। রোজার মধ্যেও তাঁরা দুধের দাম ৪২ থকে ৪৪ টাকা লিটার দরে পেয়েছেন। অথচ মিল্ক ভিটা থেকে এখন দেওয়া হচ্ছে ৪০ থেকে ৪১ টাকা। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ৩৫০ টাকা মণ দরের খড় ৫০০ টাকা, ৩৩ টাকা কেজি দরের গমের ভুসি ৫৬ টাকা হয়েছে।

বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটার উপমহাব্যবস্থাপক সাইদুল ইসলাম বলেন, গত ৩০ মে তাঁরা ৭৬ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করেছেন। তবে সপ্তাহ দু-এক আগে এই সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ৯১ হাজার লিটার। তাঁদের তালিকাভুক্ত খামারিদের (সদস্য) উৎপাদিত সব দুধই তাঁরা নিচ্ছেন। তবে এই মৌসুমে দুধের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে আসায় তাঁদের সংগ্রহ কম হচ্ছে। আর ৪ মাত্রার ননিযুক্ত দুধের সংগ্রহ দাম গতবারের চেয়ে এবার বরং এক টাকা বাড়িয়ে প্রতি লিটার ৪১ টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়েছে।

সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম জামাল আহমেদ বলেন, ‌খামারিদের দুর্দশা লাঘবের ব্যাপারে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দ্রুত তাঁদের জন্য আর্থিক ও অন্য সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আর্থিক অনুদান চেয়ে একটি প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হচ্ছে।