কথিত চিকিৎসকের ওষুধে শিশুটির সর্বনাশ

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ফাইল ছবি

আট দিন ধরে এক ফোঁটা পানিও পান করতে পারেনি শিশুটি। গলার স্বরও যেন বন্ধ হয়ে গেছে। সারা শরীরে ফোসকা। ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে, সেটিও বোঝার উপায় নেই। এভাবে বৃহস্পতিবার থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে সাত বছরের আবদুর রাফি।

রাজশাহীর কাটাখালীতে চিকিৎসক সাজা কথিত মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পরামর্শে ওষুধ সেবন করে শিশুটি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নিজেকে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দাবি করা ওই ব্যক্তির নাম মো. মফিজুল হক। কাটাখালী বাজারে তাঁর একটি চেম্বার আছে। সেখানে তিনি নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা দেন।

মফিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ইন্টার্নশিপ করেছিলেন, তাই তিনি নামের শেষে এই হাসপাতালের নাম লিখেছেন।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রাফি অসাড় হয়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে। পাশেই তার ফুফু রানী বেগম বসা। তিনি বলেন, ছেলের দাঁতের কামড় (ব্যথা) হয়েছিল। তারপর ওই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি একটা দাঁত তুলে দেন। বাড়িতে এসে ছেলে আর দাঁতের ব্যথায় বাঁচে না। ৭ সেপ্টেম্বর আবার তাঁর কাছে নিয়ে গেলে তিনি একটি সিরাপ লিখে দেন। ওই সিরাপ খাওয়ানোর পরপর ছেলে ছটফট করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলের ঠোঁট–মুখ ফুলে যায় আর গায়ে ফোসকা পড়তে থাকে।

পরদিন রাফিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখানো হয়। এরপর তার অবস্থার অবনতি হয়। ৯ সেপ্টেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে সে আর ঠিকমতো চোখ মেলতে পারছে না। সারা শরীরে পুড়ে যাওয়ার মতো ফোসকা পড়েছে। লিঙ্গ ফুলে উঠেছে। প্রস্রাব করতেও পারছে না।

মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা রোগনির্ণয় কেন্দ্রে শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তাঁরা চিকিৎসা দিতে পারেন না।
মো. নওশাদ আলী, অধ্যক্ষ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ

শিশুটিকে চিকিৎসা দেওয়া কথিত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মো. মফিজুল হকের ব্যবস্থাপত্রে দেখা যায়, তাঁর চেম্বারের নাম ভাই ভাই ডেন্টাল কেয়ার। ব্যবস্থাপত্রে তাঁর নামের পরে লেখা রয়েছে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ডেন্টাল), এফটি, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ রেজি. নম্বর ৭৬৫৩। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসকেরাই এই নিবন্ধন নম্বর পেয়ে থাকেন। তবে তাঁর নিবন্ধন নম্বরটি ভুয়া। আর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এই নামের কোনো ডিগ্রি দেওয়া হয় না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মফিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ইন্টার্নশিপ করেছিলেন, তাই তিনি নামের শেষে এই হাসপাতালের নাম লিখেছেন। রেজিস্ট্রেশন নম্বর কোথায় পেলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোগীর অভিভাবকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। এরপর যত প্রশ্ন করা হয়েছে। তার কোনোটিরই উত্তর না দিয়ে তিনি শুধু বলেছেন, রোগীর অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়েছে। আবার সাংবাদিক কেন!

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. নওশাদ আলী জানান, মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা রোগনির্ণয় কেন্দ্রে শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তাঁরা চিকিৎসা দিতে পারেন না।

এদিকে হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান বেলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আজ শিশুটির শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে এটা হয়েছে। তাকে যে সিরাপটি দেওয়া হয়েছিল, সাধারণত খিঁচুনি হলে তা দেওয়া হয়। কিন্তু তার খিচুনি ছিল না। দাঁতব্যথা ছিল।

কাটাখালী পৌরসভার মেয়ের আব্বাস আলী বলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, মফিজুল হক একজন প্রতারক। তাঁর চিকিৎসা দেওয়ার কোনো বৈধতা নেই। তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং কাটাখালী বাজার থেকে চেম্বারও তুলে দেওয়া হবে।

এদিকে মফিজুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে শিশুটির পরিবার আজ কাটাখালী থানায় গিয়েছিল। তবে থানা থেকে ওই শিশুর পরিবারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর অভিযোগ জানায়।