কদর বেড়েছে জাহাপুরের লিচুর

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার জাহাপুর গ্রামের একটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে লিচু
ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনার ঈশ্বরদী ও মাগুরার ইছাখাদা এলাকার পাশাপাশি ফরিদপুরের জাহাপুরের লিচুও বাজারে সুনাম কুড়াচ্ছে। সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতারা লুফে নিচ্ছেন এই এলাকার লিচু।

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার জাহাপুর ইউনিয়নের জাহাপুর গ্রামে অনেকেই এখন লিচুর বাগান করছেন। অনেকে অন্যান্য ফসল উৎপাদন ছেড়ে দিয়ে লিচু চাষে ঝুঁকেছেন। লিচুগাছ নেই, এমন একটিও বাড়ি যেন খুঁজে পাওয়া যাবে না এ এলাকায়। বাড়িতে এক শতক বাড়তি জমি থাকলেই সেখানে রোপণ করা হয়েছে লিচুগাছ।
ফরিদপুরে বাণিজ্যিকভাবে লিচুর চাষ হয়ে আসছে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। তবে গত ১৪-১৬ বছরের মধ্যে লিচুর আবাদ অনেক বেড়েছে।

ফরিদপুরের বিভিন্ন বাজারে মোজাফফরপুরী জাতের ১০০ লিচু ২০০ থেকে ২২৫ টাকা, বোম্বাই জাতের ১০০ লিচু ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং চায়না থ্রি জাতের লিচু ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এ ব্যাপারে লিচুবাগানের কয়েকজন মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে সময়ে লিচু হয়, সে সময়ে বিভিন্ন ধরনের ডাল, গম, পাট ও ধানের চাষও হয়। বর্তমানে শ্রমিকের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং লিচু লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষের প্রতি চাষিরা আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

ফরিদপুরের বিভিন্ন বাজারে মোজাফফরপুরী জাতের ১০০ লিচু ২০০ থেকে ২২৫ টাকা, বোম্বাই জাতের ১০০ লিচু ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং চায়না থ্রি জাতের লিচু ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাহাপুরে বেশ কয়েকজনের লিচুর বাগান রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোজাফফরপুরী জাতের। কিছু বোম্বাই, চায়না থ্রি, বেদানা, ভেরি জাতের। লিচুচাষিরা জানান, মোজাফফরপুরী জাতের লিচুর ফলন ভালো, বোম্বাই জাতও মানসম্মত। যদিও সব ফলই গাছে এক বছর বেশি ধরে, পরের বছর কম। মোজাফফরপুরী ও বোম্বাইয়ের ফলন চলনসই, তবে চায়না জাতের লিচুর ওপর একেবারে ভরসা করা কঠিন। তাই লিচুচাষিদের মধ্যে মোজাফফরপুরী জাতের লিচুর পাশাপাশি বোম্বাই জাতের লিচুর প্রতি আগ্রহ বেশি। পাকার দিক থেকে মোজাফফরপুরী জাতের লিচু আগে পাকে, বোম্বাই পাকে এর চেয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন পরে।

বাগান থেকে পাড়া লিচু বিক্রি করার জন্য বাছাই করছেন শ্রমিকেরা। গত বুধবার ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার জাহাপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

জাহাপুর ইউনিয়নের জাহাপুর, দপ্তরদিয়া, টেংরাকন্দি, মনোহরদিয়া, চর মনোহরদিয়া, খাড়াকান্দি ও মির্জাকান্দি গ্রাম এবং পাশের ফরিদপুর সদরের চাঁদপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর ও চতরবাজার কান্দি গ্রামে লিচুর আবাদ বেশি হয়।

গত বুধবার বেলা ১১টার দিকে জাহাপুর গ্রামের আবদুস সাত্তার শেখের লিচুবাগানে কথা হয় লিচুর ব্যাপারী মো. রাজু মোল্লার (৪৯) সঙ্গে। এ বাগানে গাছের সংখ্যা ১৩০। এটিই এ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় লিচুবাগান। বিভিন্ন জায়গার লিচু বিক্রির অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে রাজু মোল্লা বলেন, তিনি একজন মৌসুমি ফল ব্যাপারী। লিচুর সময় দিনাজপুর, রাজশাহী, ঈশ্বরদী কিংবা ইছাখাদা—এমন কোনো জায়গা নেই, যে জায়গার লিচু তিনি বিক্রি করেননি। তবে তাঁর অভিজ্ঞতা হলো, অন্য অঞ্চলে বড় আকারের মিষ্টি লিচু পাওয়া গেলেও জাহাপুরের লিচুর কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে। এ লিচুর রং ভালো, মান ভালো, খেতে সুস্বাদু, দামও সহনশীল। এ জায়গার লিচু পাকে আগে। গত ঈদুল ফিতরের সময় থেকেই বাজারজাত করা যাচ্ছে জাহাপুরের লিচু।

জাহাপুরের প্রবীণ লিচুচাষি আবদুস সাত্তার শেখ (৭৫) বলেন, জাহাপুরে প্রায় ৩০০ বছর আগে এক জমিদার পরিবারের উদ্যোগে ভারতের মাদ্রাজ থেকে লিচুর গাছ এনে প্রথম লিচুর বাগান করা হয়। পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাগানের লিচুগাছগুলোও কাটা পড়ে। আবদুস সাত্তার শেখই ৫৪ বছর আগে ওই জমিদারের আমলের বেঁচে যাওয়া লিচুগাছ কিনে নিয়ে জাহাপুরে লিচুবাগান করেন। তাঁর বাগানে অন্তত ৩০০ বছরের পুরোনো মোজাফফরপুরী জাতের একটি লিচুগাছ রয়েছে। পরের গাছগুলো ওই গাছ থেকে কলম করা।

সাত্তার শেখের দেখাদেখি এলাকার সুলতান আহমেদ, শাহজাহান মোল্লা, বজলু মল্লিক ফসল আবাদ বাদ দিয়ে লিচু চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং লিচুর বাগান করেন।
এলাকার আশরাফ আহমেদের একটি লিচুবাগানে ৭০টি গাছ রয়েছে। তিন বছরের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় ওই বাগান ইজারা নিয়েছেন জাহাপুর এলাকার বাসিন্দা রিয়াজ মিয়া (৩৪)। রিয়াজ বলেন, চলতি বছর ফলন কম। তবে আগামী বছর পুষিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে শ্রমিকের অনেক মূল্য, তাই নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে উৎসবের সঙ্গে কাজ করছি।’

ওই বাগানে কথা হয় ব্যাপারী আমজাদ শেখের সঙ্গে (৬৩)। তিনি বলেন, জাহাপুরের লিচুর মান ভালো। দেশে সুনাম আছে। এখানকার লিচু ফরিদপুর ও এর আশপাশের জেলা ছাড়াও ঢাকায় পাঠানো হয়। ভালো কদর পায়।

মধুখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলভীর রহমান বলেন, এ উপজেলায় ২৬ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়। প্রতি হেক্টরে ৯ মেট্রিক টন লিচু উৎপাদন হয়েছে। প্রতি কেজি ২০০ টাকা করে বিক্রি হলে কৃষকদের সাড়ে ৪ কোটি টাকার বেশি আয় হবে।

ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হযরত আলী বলেন, ‘জেলার মধ্যে মধুখালী ছাড়াও বোয়ালমারী ও ফরিদপুর সদরে লিচুর বাণিজ্যিক আবাদ হচ্ছে। তবে জেলার মোট কী পরিমাণ জমিতে লিচুর আবাদ এবং উৎপাদন হয়, এ পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই।’