‘কবরী রোডে’ আর যাওয়া হলো না ‘মিষ্টি মেয়ের’

সারাহ বেগম কবরী
ছবি : সংগৃহীত

বাংলা সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরীর খুব ইচ্ছা ছিল অন্তত একবারের জন্য হলেও চুয়াডাঙ্গায় যাবেন। সেখানে তাঁর নামে নাম হওয়া ‘কবরী রোড’ দেখে আসবেন। সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না তাঁর। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৩ দিনের মাথায় গতকাল শুক্রবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন তিনি।

২০১৬ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পাওয়ার পর প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সারাহ বেগম কবরী বলেছিলেন, ‘আমাকে বললে আমি যাব। নিজ খরচেই যাব। বেঁচে থাকতে রাস্তাটি দেখে যেতে চাই।’ তবে ‘কবরী রোডে’ আর তাঁর যাওয়া হয়নি। নিজের চোখে দেখা হয়নি তাঁর জন্য এত বছর ধরে ভক্তদের ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন।

চুয়াডাঙ্গা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নাম ‘কবরী রোড’। ৪০০ মিটার দীর্ঘ রাস্তাটি পৌরভবন ও সরকারি কলেজকে সংযুক্ত করেছে। কবরীর নামে ১৯৬৯ সাল থেকে স্থানীয়রা সড়কটিকে বলে ‘কবরী রোড’। ভক্তদের ভালোবাসায় ৫২ বছর ধরে রাস্তাটি টিকে আছে। এই রাস্তায় রয়েছে সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি অফিস, অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সাংসদ সোলায়মান হক জোয়ার্দারের বাসভবন।

যেভাবে হলো ‘কবরী রোড’

বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। ১৯৬৯ সালে চুয়াডাঙ্গায় শুটিং হয়েছিল নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘কখগঘঙ’ সিনেমার, যার প্রধান চিত্রগ্রাহক ছিলেন বেবী ইসলাম এবং সহকারী চিত্রগ্রাহক মোরশেদ আহমেদ ওরফে তোকা মিয়া। এই দুজন সম্পর্কে ছিলেন মামাতো-ফুফাতো ভাই। কাহিনির প্রয়োজনে সিনেমাটির বড় একটি অংশের শুটিং হয়েছিল মোরশেদ আহমেদের চুয়াডাঙ্গা শহরের বাড়িতে। এই বাড়ির অবস্থান বর্তমানের কবরী রোডে। বাড়ির মালিক সপরিবারে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করছেন। বাড়ির একটি অংশে ব্যবসায়ী আখের আলী স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ থাকেন। অপর অংশ ‘কবরী মেস’ নামে পরিচিত।

‘কখগঘঙ’ সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সারাহ বেগম কবরী, রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ, রহিমা খালা ও বেবী ইসলামের স্ত্রী তন্দ্রা ইসলাম। কবরী রোড প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তন্দ্রা ইসলাম ২০১৬ সালে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘১৯৬৯ সালে যখন চুয়াডাঙ্গায় “কখগঘঙ” সিনেমার শুটিং হয়, তখন কবরী খুব জনপ্রিয় ছিলেন। সবাই দেখতে আসত। বলত, কবরী কোথায় থাকে? লোকজন দেখিয়ে দিত, ওই যে ওই বাড়িতে। রিকশাচালকেরা উৎসুক লোকজনকে নিয়ে আসতেন। শুটিংয়ের এক মাসেই এভাবে মুখে মুখে বোধ হয় রাস্তাটির নাম কবরী রোড হয়ে গেল।’

‘কবরী রোডের’ কথা জানতেন কবরীও

২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর প্রথম আলোয় ‘চুয়াডাঙ্গার সংস্কৃতিচর্চা এবং কবরী রোডের গল্প’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন তৈরির আগে কবরীর কাছে ‘কবরী রোড’ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কবরী সেদিন বলেছিলেন, ‘এক মাস ধরে চলল শুটিং। আমি তখন ছোট, বয়স কম। শহরটিও ছোট্ট। তবু মানুষজনের যেন কমতি ছিল না। ...আসলে আমরা তো সেখানে খুব সাধারণভাবে ছিলাম। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছি। মাটিতে বসে গল্প করেছি। শুটিংয়ে সবার সঙ্গে টিনের থালায় খেয়েছি। তারাও আমাদের সাধারণভাবেই নিয়েছে। এক মাস পর শুটিং শেষে ফিরে আসার সময় তো আমার মন খুবই খারাপ হয়ে গেল। লোকজনকে বলেছি, আমি আবার আসব। কিন্তু আর যেতে পারিনি…।’

স্মৃতি হাতড়ে মিষ্টি মেয়ে কবরী প্রথম আলোর প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর এলাকার লোকজন কবরীকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠির ভেতরে ছিল আরেকটি খাম। যেখানে লেখা ছিল, কবরী রোড, চুয়াডাঙ্গা।

‘কবরী রোডের’ বর্তমান বাসিন্দারা

কবরী রোডের বাসিন্দা মাহবুব আলম টেলিকম ব্যবসায়ী। এই রাস্তার পাশেই তাঁর বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়িক প্রয়োজনে অনেক নামীদামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। ঠিকানা ‘কবরী রোড’ জানার পর প্রত্যেকের মধ্যে আলাদা অনুভূতি দেখতে পারি। সব শ্রেণির মানুষ খুব সহজে কবরী রোডকে চেনে। এই রাস্তার দুই পাশের বাসিন্দাদের জন্য এটা ইতিবাচক।’

কবরী রোডের যে বাড়িতে সিনেমার শুটিং হয়েছিল, সেই বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা নিলুফা বেগম বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ১৬ বছর স্বামী আখের আলীর সঙ্গে এই বাড়িতে থাকি। এই বাড়িতেই আমার দুই সন্তান আবুল বাশার ও মেহেদী হাসানের জন্ম। আমি গর্বিত। যে বাড়িতে, যে ঘরে নায়িকা কবরী এক মাস ছিলেন, আমি সেই ঘরের বাসিন্দা।’