কবিগুরুর স্মৃতিধন্য আঠারোবাড়ি জমিদারবাড়ি

আঠারোবাড়ির জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরী শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্রের আমন্ত্রণ রক্ষা করতেই আঠারোবাড়ি এসেছিলেন বিশ্বকবি
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ববঙ্গ ভ্রমণের অনেক স্মৃতি ও স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। এর মধ্যে জমিদারি দেখাশোনার জন্য কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে এসেছিলেন ১৮৮৯ সালে। ১৯৫৮ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহের কুঠিবাড়িটি গৌরবময় স্মৃতিরূপে সংরক্ষিত আছে। ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কবিগুরু এসেছিলেন ময়মনসিংহের আঠারোবাড়ি জমিদারবাড়িতে। তবে জমিদারি করতে নয়, তাঁর ছাত্র জমিদার প্রমোদ রায় চৌধুরীর কাছারিঘর উদ্বোধন করার জন্য।

কবিগুরুর আগমনের স্মৃতি বহন করে সুবিশাল সেই জমিদারবাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু শিলাইদহের কুঠিবাড়ির মতো এখানে কবিগুরুর স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ ৯৫ বছরেও নেওয়া হয়নি। ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে অগ্রসর হলেই চোখে পড়বে জমিদারবাড়ির বিশাল অট্টালিকা। জমিদারবাড়ির আঙিনায় ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আঠারোবাড়ি ডিগ্রি কলেজ। প্রতিষ্ঠানটি এলাকায় শিক্ষার প্রসারে অবদান রাখছে। তবে কবিগুরুর আগমনের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কলেজের পক্ষ থেকেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই ঈশ্বরগঞ্জের আঠারোবাড়ি ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগে অগ্রসর একটি এলাকা। এমন একটি সমৃদ্ধ এলাকায় জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায়ের পরিত্যক্ত দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল জমিদারবাড়ি এখন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চমৎকার কারুকার্যময় এ রাজবাড়ির বয়স প্রায় আড়াই শ বছর। এর আঠারোবাড়ি নামটির পেছনেও রয়েছে এক ইতিহাস।

১৭৯৩ সাল পর্যন্ত হোসেনশাহি পরগনা রাজশাহী কালেক্টরের অধীনে ছিল। সে সময় মহারাজ রামকৃষ্ণের জমিদারি খাজনার দায়ে নিলামে উঠলেও পরগনাটি খাজে আরাতুন নামে এক আর্মেনীয় ক্রয় করেন। ১৮২২ সালে আরাতুনের দুই মেয়ে বিবি কেথারিনা, বিবি এজিনা এবং তাঁর দুই আত্মীয় স্টিফেন্স ও কেসপার্জ প্রত্যেকে চার আনা অংশে এ পরগনার জমিদারি লাভ করেন। ১৮৫৩ সালে আঠারোবাড়ি জমিদার সম্ভুরায় চৌধুরী বিবি এনিজার অংশ কিংবা মতান্তরে কেসপার্জের অংশ ক্রয় করেন। পরে মুক্তাগাছার জমিদার রামকিশোর চৌধুরীর জমিদারি ঋণের দায়ে নিলামে উঠলে তা সম্ভুরায় চৌধুরীর ছেলে মহিম চন্দ্র রায় চৌধুরী কিনে নেন।

শুধু তা-ই নয়, ১৯০৪ সালে মহিম চন্দ্র রায় চৌধুরীর স্ত্রী জ্ঞানদা সুন্দরীর স্বামীর উত্তরাধিকার ও ক্রয়সূত্রে পরগনায় ১৪ আনার মালিক হন। বাকি দুই আনা অন্য এলাকার জমিদাররা কিনে নেন। জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর তাঁদের আয়ত্তে আসে উত্তর গৌরীপুরের রাজবাড়ি, পশ্চিমে রামগোপাল পুর, ঢৌহাখলা, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর ও নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা। তা ছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুর জেলার কয়েকটি মৌজা, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বেশ কিছু মৌজা ছিল এ জমিদারের দখলে। প্রতিবছর নির্দিষ্ট একটি সময়ে এসব জেলা শহরে স্থাপিত আঠারোবাড়ি কাছারিবাড়িতে নায়েব উপস্থিত হয়ে খাজনা আদায় করতেন। আজও এসব কাছারি ‘আঠারোবাড়ি বিল্ডিং’ নামে নিজ নিজ জেলায় পরিচিতি পেয়েছে।

জমিদার সম্ভুরায় চৌধুরীর বাবা দীপ রায় চৌধুরীর প্রথম নিবাস ছিল বর্তমান যশোর জেলায়। তিনি যশোর জেলার একটি পরগনায় জমিদার ছিলেন। এক সময় দীপ রায় চৌধুরী তাঁর ছেলে সম্ভুরায় চৌধুরীকে নিয়ে যশোর থেকে আলাপ সিং পরগনায়, অর্থাৎ আঠারোবাড়িতে আসেন। আগে এ জায়গাটার নাম ছিল শিবগঞ্জ বা গোবিন্দবাজার। দীপ রায় চৌধুরী ছেলের নামে জমিদারি ক্রয় করে এ এলাকায় এসে দ্রুত আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন। সেই সঙ্গে এলাকার নাম পরিবর্তন করে তাঁদের পারিবারিক উপাধি ‘রায়’ থেকে রায়বাজার রাখেন। আরেকটি অংশে এক একর জমির ওপর নিজে রাজবাড়ি, পুকুর ও পরিখা তৈরি করেন। দীপ রায় চৌধুরী যশোর থেকে আসার সময় রাজপরিবারের কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য আঠারোটি হিন্দু পরিবার সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাঁদের রাজবাড়ি তৈরি করে দেন। তখন থেকে জায়গাটি আঠারোবাড়ি নামে পরিচিত লাভ করে।

কবিগুরুর আগমনের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আঠারোবাড়িতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অবহেলার শিকার হয়ে জমিদারবাড়ির সব ভবন আজ ধ্বংসপ্রায়
ছবি: প্রথম আলো

দীপ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সম্ভুরায় চৌধুরী জমিদারি লাভ করেন। তবে তাঁর কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় তিনি নান্দাইল উপজেলায় খারুয়া এলাকা থেকে এক ব্রাহ্মণসন্তানকে দত্তক এনে লালন-পালন করেন। ওই সন্তানই প্রমোদ রায় চৌধুরী, যিনি একসময় জমিদারির উত্তরসূরি হন। বিভিন্ন বইপত্র ও নথি ঘেঁটে জানা যায়, আঠারোবাড়ির জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরী শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী ছিলেন। কবিগুরু ছিলেন তাঁর শিক্ষক। ছাত্রের আমন্ত্রণ রক্ষা করতেই আঠারোবাড়ি এসেছিলেন বিশ্বকবি।

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভে সংবর্ধনা গ্রহণ এবং শান্তিনিকেতনকে বিশ্বভারতী করে গড়ে তুলতে নৈতিক ও আর্থিক সমর্থনের লক্ষ্যে ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন রবীন্দ্রনাথ। প্রায় এক সপ্তাহ ঢাকায় অবস্থান শেষে তিনি ময়মনসিংহের উদ্দেশে যাত্রা করেন। রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক যতীন সরকার জানান, ১৫ ফেব্রুয়ারি কবিগুরু ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে পৌঁছান। সেখানে কবিগুরুকে বরণমালা পরিয়ে দেন মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজ শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী (যাঁর নামে ময়মনসিংহের শশী লজ প্রতিষ্ঠিত)। এ সময় উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি দেওয়া হয়।

শত হস্তে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে বিশ্বকবিকে স্বাগত জানানো হয়। এ সময় কবির পাশে ছিলেন তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, নাতি দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইতালীয় অধ্যাপক জোসেফ তুচি প্রমুখ। সেখানে কয়েক দিন থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের দেওয়া সংবর্ধনা গ্রহণ করেন কবিগুরু।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা (ভূঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত) গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কবিগুরু ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে আঠারোবাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। সেদিন তাঁকে একনজর দেখার জন্য ঈশ্বরগঞ্জ ও গৌরীপুরের হাজার হাজার মানুষ ঈশ্বরগঞ্জ সদরে চলন্ত ট্রেন থামিয়ে দেন। এরপর আঠারোবাড়ি রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পর কবিকে হাতির পিঠে চড়ানো হয়। এ সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিবাদন জানানো হয়। শত শত মানুষ জয়ধ্বনি করতে করতে তাঁকে জমিদারবাড়ির মূল ফটক পর্যন্ত নিয়ে যান। মূল ফটকের কাছে কবিকে সোনার চাবি উপহার দেন জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরী। ওই চাবি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কাছারিঘরের মূল ফটক খোলেন। কবির সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া বসে বাউল, জারি-সারি গানের আসর।

সেই কাছারিঘরটি এখনো আছে। তবে যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করায় কাছারিঘরটি এখন জীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে জমিদারবাড়ির আঙিনায় কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে আমন্ত্রিতরা কবির স্মৃতিরক্ষার তাগিদ দেন। নানা পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। আশ্বাস পেয়ে কবির ভক্ত ও অনুরাগীরা আশান্বিত হন। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সেই আশ্বাসের আর বাস্তবায়ন হয় না। স্থানীয় কিছু সাহিত্য পত্রিকা ও কয়েকজন রবীন্দ্রগবেষকের গবেষণাপত্র ছাড়া কবিগুরুর আগমনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

জমিদারবাড়ির সামনে রয়েছে বিশাল পুকুর। পুকুরে রয়েছে রাজঘাট। কথিত আছে, কবিগুরু এই রাজঘাটে বসে গান লিখেছিলেন। স্থানীয় সচেতন মহল জানায়, একটু সংস্কারকাজ করলেই এবং কাছারিঘরে একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলা হলে হয়তো কবিগুরুর আগমনের সেই স্মৃতি ধরে রাখা সম্ভব হতো।

ছড়াকার-গবেষক ও জলদ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক স্বপন ধর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দেশের বিভিন্ন সংগ্রহশালা থেকে বইপত্র, তথ্য ও আলোকচিত্র সংগ্রহ করেছি। আঠারোবাড়ির জমিদার প্রমোদ রায় চৌধুরীর বাড়িতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমনের বিষয়ে বিস্তর নথিপত্র রয়েছে। তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ওই ভ্রমণের কথা ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল।’

স্বপন ধর আরও বলেন, কবিগুরুর আগমনের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আঠারোবাড়িতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অবহেলার শিকার হয়ে জমিদারবাড়ির সব ভবন আজ ধ্বংসপ্রায়। কবিগুরুর আগমনের স্মৃতি রক্ষায় কাছারিঘরটি সংস্কার করে কবির স্মৃতিধন্য স্থান হিসেবে গড়ে তোলা এখনো সম্ভব।

আঠারোবাড়ি ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সহীদুর রহমান বলেন, জমিদারবাড়ির কাছারিঘরটি, যেটি স্বয়ং কবিগুরু দ্বারোদ্‌ঘাটন করেছিলেন, সেটি কবিগুরুর স্মৃতিভবন হিসেবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। একটি বেসরকারি কলেজের পক্ষে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ বিষয়ে সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।