কম খরচে বেশি লাভ, তরমুজ চাষে ঝোঁক সবার

খুলনায় জমিতে তরমুজের বীজ রোপণের কাজ করছেন কিষান–কিষানিরা। সম্প্রতি খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালী গ্রামের বিলেছবি: প্রথম আলো

খুলনার দাকোপ উপজেলা সুস্বাদু তরমুজের জন্য বিখ্যাত। তরমুজ চাষ করে অল্প সময়ে বেশি লাভ পাওয়া যায়। তাই তরমুজ চাষে অনেক কৃষক ঝুঁকছেন। গত বছরের চেয়ে এবার দ্বিগুণ জমিতে তরমুজের আবাদ হচ্ছে। এবারপতিত জমিতে প্রথমবারের মতো তরমুজ চাষে নেমেছেন অনেক চাষি। উপজেলাজুড়ে এখন চলছে তরমুজ আবাদের মহাযজ্ঞ।

দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়ার অন্তত ২০টি গ্রামের যত দূর চোখ যায় তত দূর পর্যন্ত শুধু তরমুজের খেত। ৪ ও ৫ মার্চ এসব গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ জমিতে বীজ রোপণ করা হয়ে গেছে। কিছু জমিতে এখন বীজ রোপণের কাজ চলছে। কোথাও আবার চারা বাড়তে শুরু করেছে। সার, পানি ও কীটনাশক ছিটানোয় ব্যস্ত সময় পার করছেন কিষান-কিষানিরা।

অধিক লাভ হওয়ায় পতিত জমিতে প্রথমবারের মতো তরমুজ চাষ করছেন বিমল কৃষ্ণ রায়। খুলনার দাকোপ উপজেলার চালনা পৌরসভার পাশের পানখালী বিলে বেশ কিছু পতিত জমি আছে। বিমলসহ ৫ জন মিলে এই বিলের ১৫ বিঘা জমিতে তরমুজ আবাদ করছেন। তিনি বলেন, ‘এ রকম সময় অন্য বছর এসব জমি পড়েই থাকত। তরমুজ চাষ লাভজনক হওয়ায় আমরা এবার প্রথমবারের মতো চেষ্টা করছি। এই বিলে যাঁরা তরমুজ চাষ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নতুন কৃষক।’

দাকোপের কালিকাবাটি গ্রামের কৃষক চিত্তরঞ্জন মণ্ডল বলেন, গত বছর তরমুজে ব্যাপক লাভ হয়েছিল। কিছু কিছু কৃষক বিঘায় দেড় লাখ টাকার বেশি লাভ করেছিলেন। এ কারণে এবার প্রায় সবাই আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত পানির সংকট হতে পারে বা দাম কমে যেতে পারে বলে অনেকে শঙ্কায় আছেন।

  • খুলনা জেলায় এবার প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।

  • দাকোপে তিন হাজার হেক্টরে আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ১৫০০ হেক্টর পতিত জমি।

  • গতবার দাকোপ থেকে এক হাজার কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, খুলনা বিভাগের মধ্যে খুলনায় সবচেয়ে বেশি তরমুজের চাষ হয়। ২০১৪ সালে জেলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজের আবাদ হয়। ওই বছর জেলায় ৩ হাজার ৪৬৮ হেক্টর জমিতে তরমুজ হয়েছিল। তবে সেবার ফসল তোলার সময় বৃষ্টি ও খারাপ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে জেলার কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়ে। ফলে ২০১৫ সালে জেলায় আগের বছরের ছয় ভাগের এক ভাগ জায়গায় তরমুজের আবাদ হয় ।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র আরও জানায়, ২০১৭ সাল থেকে তরমুজের আবাদ আবার একটু একটু বাড়তে থাকে। গত বছর  জেলায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে ১ লাখ ২০ হাজার টন তরমুজ হয়েছিল। চলতি বছর প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হচ্ছে। আবার জেলার মোট উৎপাদিত তরমুজের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ দাকোপ উপজেলায় উৎপাদিত হয়। গত বছর দাকোপে ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আবাদও করা হয়েছিল। এবার ৩ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আইলায় কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়নের অনেক জায়গায় এবার প্রথমবারের মতো তরমুজের আবাদ হচ্ছে।

দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, গত মৌসুমে করোনার মধ্যেও উৎপাদিত তরমুজের বাজারমূল্য ছিল প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এবার  দ্বিগুণ জমিতে আবাদ হয়েছে। গত বছর ব্যাপক বাজার পাওয়ায় প্রচুর কৃষক এবার তরমুজে ঝুঁকেছেন।

  • আমন ধানের বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তুলতে ৫ মাস সময় লাগে। প্রতি বিঘায় আমন ধান উৎপাদনে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকা পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে প্রতি বিঘায় আমন আবাদ করে ৯ হাজার টাকা লাভ হয়।

  • অন্যদিকে তরমুজের বীজ বোনা থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত সময় লাগে সর্বোচ্চ আড়াই মাস। বিঘায় খরচ হয় ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। বিঘায় বিক্রি হয় সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮৫ হাজার টাকায়। এতে বিঘা প্রতি তরমুজ চাষ করে সর্বোচ্চ ৭১ হাজার টাকা লাভ হয়।

ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর ইউনিয়নের ঝালতলা বিলেও কেবল একবার ফসল হতো। গত বছর পাঁচজন কৃষক ৫ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলেন। এবার এ মাঠেরই ১৫০ একর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।
ঝালতলা বিলের পতিত জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন পঙ্কজ কুমার গাইন। তিনি বলেন, ‘আমনের পর এই বিল পড়ে থাকত। গত বছর এখানে মাত্র কয়েকজন তরমুজ লাগিয়েছিলেন। তরমুজ বিক্রি করে ব্যাপক লাভবান হন তাঁরা। তাঁদের দেখাদেখি এবার আমরা ১০০ জনের বেশি তরমুজের চাষ করেছি। কম বিনিয়োগ আর কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় তরমুজে এত আগ্রহ।’
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, এ বছর উপজেলার ঝালতলা, শরাফপুর, বাহির আকড়া, মাগুরখালি, শোভনা, শিবপুর, মাদারতলা বিলের যেদিকে চোখ যায় কেবল তরমুজের ক্ষেত। এবার ৪৫০ একর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতবার কৃষকেরা তরমুজে ব্যাপক লাভ করেছিলেন। জেলার অনেক এক ফসলি বিলে প্রথমবারের মতো তরমুজ আবাদ হচ্ছে। আবহাওয়া শেষ পর্যন্ত অনুকূলে থাকলে উৎপাদনও অনেক ভালো হবে। তবে বিপণন ব্যবস্থা আরও ভালো না হলে চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়বেন।