কমিশনে বিক্রি হচ্ছে ১০০০, ৫০০ ও ১০০ টাকার জাল নোট

অপরাধ
প্রতীকী ছবি

কক্সবাজার শহরের বাজারঘাটা এলাকার একটি ফলের দোকানে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে এক তরুণী আসেন। বোরকা পরা ওই তরুণী দরদাম করে পাঁচ শ টাকায় দুটি তরমুজ কেনেন। এরপর ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে উঠে বার্মিজ মার্কেটের দিকে চলে যান তিনি। কিছুক্ষণ পর আরেক ক্রেতাকে টাকা দিতে গিয়ে তরমুজের দোকানদার জানতে পারেন, তরুণীর দেওয়া ৫০০ টাকার নোটটি নকল। এরপর আর ওই তরুণীর খোঁজ মেলেনি।

ক্ষোভ প্রকাশ করে ফল বিক্রেতা আমজাদ হোসেন (৪৫) বলেন, পবিত্র রমজান মাসেও প্রতারণার শেষ নেই। ঈদের বাজারে জাল টাকার ছড়াছড়ি চলছে। ইফতারির আগমুহূর্তে লোকজনের ভিড়ে প্রচারক চক্র জাল নোটের চালান করছে। চকচকে জাল নোট আসল না নকল বোঝাও কঠিন।

আগের দিন বুধবার সন্ধ্যায় শহরের বিমানবন্দর সড়কের কানাইয়ার বাজারে প্রতারণার শিকার হন স্থানীয় সমিতিপাড়ার বৃদ্ধ নজির আহমদ। তিনি বাজারে বসে মুরগি বিক্রি করছিলেন। এক তরুণ তাঁর কাছ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় চারটি মুরগি কেনেন। কিছুক্ষণ পর ওই বৃদ্ধ আরেকটি দোকানে গিয়ে ঘরের জন্য চাল ও তেল কেনেন। দোকানদারকে টাকা দিলে ধরা পড়ে জাল নোট। মুরগি বিক্রির ১ হাজার ৭০০ টাকার মধ্যে মাত্র ১০০ টাকার দুটি নোট ছিল আসল। অবশিষ্ট দেড় হাজার টাকার দুটি নোট (১০০০ ও ৫০০ টাকা) ছিল নকল। বৃদ্ধ নজির আহমদ (৬৭) বলেন, খালি চোথে তিনি নকল টাকা চিনতে পারেননি। খালি হাতে ঘরে গিয়ে কী জবাব দেবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।

শহরের বড়বাজার, পানবাজার, হাসপাতাল সড়ক, বাজারঘাটা, ঝাউতলা, গাড়িরমাঠ, কলাতলী হোটেল–মোটেল জোন, লিংক রোডসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার বিপণিকেন্দ্রে, হাটবাজারে প্রায় প্রতিদিন জাল নোট নিয়ে কেনাকাটা করতে এসে ধরা পড়ছেন একাধিক নারী-পুরুষ। কিন্তু পুলিশি ঝামেলার কারণে এ নিয়ে খুব একটা হইচই হয় না। ব্যবসায়ীরা বলেন, নকল টাকা নিয়ে যাঁরা ধরা পড়েন, তাঁদের বেশির ভাগ পরিচিত এবং তখন তাঁরাও অন্যের কাছে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ তোলেন। সে জন্য এ ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না।

কক্সবাজার দোকান মালিক ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঈদ সামনে রেখে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র বাজারে ১০০০, ৫০০ ও ১০০ টাকার জাল নোট ছড়াচ্ছে। ক্রেতা সেজে কিছু বেকার তরুণ, যুবক ও নারীরা জাল নোট ঈদের বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। জাল নোট শনাক্তকরণের কোনো মেশিন না থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই প্রতারিত হচ্ছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরের পাহাড় এবং জেলার দুর্গম উপকূলে জাল নোট তৈরির একাধিক আস্তানা (মেশিন) আছে। একেক দিন একেক জায়গায় স্থানান্তর হয় বলে মেশিনগুলো জব্দ করা যাচ্ছে না। মেশিন দিয়ে তৈরি চকচকে ১০০০, ৫০০ ও ১০০ টাকার জাল নোটসমূহ ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ কমিশনে বেচাবিক্রি হয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বেকার তরুণ-তরুণীদের জাল নোট বেচাবিক্রিতে কাজে লাগাচ্ছে প্রতারক চক্র। র‍্যাব ও পুলিশ সম্প্রতি টেকনাফের কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবিরে একাধিক অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ জাল নোটসহ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে জাল নোট ও নোট তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার করা হয় আরও কয়েকজনকে। কিন্তু নোট তৈরির মূল হোতাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকে পুলিশ জেলার উপকুলীয় পেকুয়া সদরের চৌমুহনী বাজার এলাকা থেকে ৮০ হাজার টাকার জাল নোটসহ মো. শফি (৪২) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। তিনি পেকুয়া সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি ঘোনা এলাকার বাসিন্দা।

পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ঈদ সামনে রেখে প্রতারক চক্র কৌশলে বাজারে জাল নোট ছড়িয়ে দিচ্ছে। বেচাকেনার ভিড়ে ক্রেতা-বিক্রেতারা জাল নোট নিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন। কেনাকাটার সময় ৮০ হাজার টাকার জাল নোটসহ শফিকে গ্রেপ্তার করা হয়। সব কটি নোট ১০০০ টাকার। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে মো. শফিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এর আগে পেকুয়া থানায় মো. শফি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তিনি জাল নোটগুলো সংগ্রহ করেন ৬০ শতাংশ কমিশনে। অর্থাৎ ১ লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি করতে পারলে তাঁকে (শফিকে) পরিশোধ করতে হবে ৪০ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ৬০ হাজার টাকা নিজের থাকে।

পুলিশ ও র‍্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, গত ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় র‍্যাব-৭–এর একটি দল সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদসংলগ্ন একটি কম্পিউটারের দোকানে অভিযান চালিয়ে ১৬ লাখ টাকার জাল নোট এবং জাল নোট তৈরির সরঞ্জামসহ চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন উপজেলা সদরের মনোহরখালীর মো. ছাইফুদ্দীন আহমদ ওরফে মিজান (২৬), কৈয়ারবিল ইউনিয়নের সাইফুল ইসলাম (২৪), মনোহরখালীর দুই ভাই মো. সিবাহ উদ্দিন (৩২) ও মো. জিয়াউদ্দিন (২০)।

র‍্যাব কর্মকর্তারা বলেন, শহর এলাকায় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অধিক তৎপর থাকায় চক্রের সদস্যরা দুর্গম সমুদ্র উপকূলকে জাল নোট তৈরির নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নেয়। গ্রেপ্তার ছাইফুদ্দীন আহমদ জাল নোট সিন্ডিকেটের মূল হোতা। সাইফুল ইসলাম কম্পিউটার বা ল্যাপটপে জাল টাকাগুলো প্রস্তুত করে কালার প্রিন্টারে প্রিন্ট করেন। মিসবাহ্ উদ্দিন জাল টাকাগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ জেলায় চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। উদ্ধার ১৬ লাখ টাকার সবগুলোই ছিল ১০০০ টাকার জাল নোট।

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা দলিলুর রহমান (৫৫) বলেন, আশ্রয়শিবিরে মাদক (ইয়াবা) বেচাবিক্রি, দোকানপাটে মালামাল কেনাকাটার সময় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নকল টাকা নিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। বিশেষ করে আসন্ন ঈদ সামনে রেখে কতিপয় রোহিঙ্গা জাল নোট ছড়িয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি টাকা আসল না নকল বুঝতে পারে না। তা ছাড়া চকচকে নতুন নোট দেখলে যে কেউ নিতে আগ্রহ দেখায়। জাল নোট ব্যবহার করে মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে মাদকদ্রব্য (ইয়াবা ও আইস) ও সোনার চালান আনা হচ্ছে ক্যাম্পে। পরে জাল নোট শনাক্ত হলে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে।