করোনা ও বৃষ্টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় তরমুজচাষিরা

পাইকার না থাকায় এভাবেই খেতে পড়ে আছে তরমুজ। গত বুধবার বরগুনার তালতলী উপজেলার কবিরাজপাড়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
পাইকার না থাকায় এভাবেই খেতে পড়ে আছে তরমুজ। গত বুধবার বরগুনার তালতলী উপজেলার কবিরাজপাড়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

করোনাভাইরাস এলোমেলো করে দিয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের তরমুজচাষিদের লাভের হিসাব-নিকাশ। তাই তরমুজের বাম্পার ফলনের হাসি এখন ফিকে হয়ে গেছে লোকসানের দুশ্চিন্তায়। কোনো পাইকার নেই। যাও দু-একজন আসছেন, তাঁরাও দাম বলছেন না। তাই খেতে পড়ে আছে তরমুজ। এই অবস্থায় কয়েক দিন ধরে অব্যাহত অসময়ের বৃষ্টিতে খেতেই পচে যাচ্ছে উৎপাদিত তরমুজ।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খারাপ আবহাওয়া সত্ত্বেও ২০১১ সালের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজের আবাদ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। লবণাক্ততা, খরা, অসময়ে বৃষ্টিপাতসহ নানা কারণে ক্ষতির মুখোমুখি হওয়ার পর এ অঞ্চলের কৃষকেরা বিকল্প ফসল উৎপাদন করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। অসময়ে বৃষ্টিপাতের কারণে ২০১৮ সালে এই অঞ্চলে তরমুজের আবাদ আগের বছরের উৎপাদনের অর্ধেকে নেমে এসেছিল। আবাদ কম হলেও ওই বছর উৎপাদন ভালো হওয়ায় গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে তরমুজের আবাদ আগের বছরের দ্বিগুণ হয়েছিল।

সূত্র আরও জানায়, এবার বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় তরমুজ আবাদ হয়েছে ২৪ হাজার ৬৮৮ হেক্টরে। ফলন ভালো হওয়ায় ১২ লাখ টন তরমুজ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে এ অঞ্চলে তরমুজ আবাদ হয়েছিল ৩৬ হাজার ৯১১ হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদনের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৭৪ মেট্রিক টন। সেই হিসাবে ২০১৯ সালে প্রায় ১৭ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদিত হয়।

বরাবরের মতো এবারও পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে পটুয়াখালীতে এবার আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৮২২ হেক্টর, যা গত বছর ছিল ২১ হাজার ৬৮২ হেক্টর। বরগুনায় আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৭৩২ হেক্টর, যা গত বছর হয়েছিল ৪ হাজার ২০০। ভোলায় আবাদ হয়েছে ৭ হাজার ৭২২ হেক্টর, গত বছর হয়েছিল ১০ হাজার ৪৯১ হেক্টরে। এ ছাড়া বরিশালে এবার আবাদ হয়েছে ৩৫১ হেক্টর, গত বছর হয়েছিল ৩৯৭ হেক্টর, পিরোজপুর জেলায় ৪৬ হেক্টর, যা গত বছর ছিল ১২১ হেক্টর এবং ঝালকাঠি জেলায় এবার ১৫ হেক্টর, গত বছর আবাদ হয়েছিল ২০ হেক্টর জমিতে।

এক সপ্তাহ ধরে বরিশাল অঞ্চলে বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। থেমে থেমে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। এতে বিপাকে পড়েছেন তরমুজচাষিরা।

বরগুনার তালতলীর কবিরাজপাড়া গ্রামের চাষি হারুন অর রশিদ এনজিও থেকে ঋণ এনে এবং ধারদেনা করে এবার ৮ একরের জমিতে তরমুজের আবাদ করেছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশ যোগাযোগবিচ্ছিন্ন থাকায় তা বিক্রি করার পাইকার পাচ্ছেন না। এরপর কয়েক দিন ধরে অসময়ের বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে উৎপাদিত এসব তরমুজ।

চাষি হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বিভিন্ন এনজিও ও ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তরমুজ চাষ করেছিলাম। এখন করোনা ভাইরাসের কারণে তরমুজ বিক্রি করতে না পেরে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছি। এখন নতুন করে বৃষ্টির কারণে খেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তরমুজ।’

আমতলীর কুকুয়া গ্রামের কৃষক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ধারদেনা আর দিন-রাত পরিশ্রম করে সাড়ে ৮ লাখ টাকা খরচ করে ২৪ একর জাগায় তরমুজ আবাদ করছিলাম। ফলনও ভালো অইছিল। ভালো ফলন দেইখ্যা বুকটা আনন্দে ভইরা উঠছিল। কিন্তু এহন কম তছনছ অওনের জোগাড়। কী হরমু কিচ্ছু কইতে পারি না। খ্যাতে সব তরমুজ পইড়া রইছে।’

কৃষি বিভাগ ও চাষিরা বলছেন, বরিশাল অঞ্চলে এবার তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে চাষিরা উৎপাদিত তরমুজ বিক্রি করতে পারছেন না। অন্যান্য বছর এই সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের বাজার, খেতগুলোয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারদের পদচারণে মুখর থাকলেও এবার তার ছিটেফোঁটাও নেই।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ধানখালী ইউনিয়নে পাঁচজুনিয়া গ্রামের তরমুজচাষি মোহাম্মদ সান্টু মাল বলেন, ‘পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে খেত থেকে তরমুজ তুলতে হবে। কিন্তু দেশের যে অবস্থা, তাতে তরমুজ বিক্রি করতে পারি কি না, তা আল্লাহই জানেন। এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তরমুজ চাষ করছি। এখন বিক্রি করতে না পারলে রাস্তায় বসা ছাড়া কোনো উপায় দেখি না।’

বরিশাল বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক তাওফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার দক্ষিণাঞ্চলের তিন জেলায় প্রচুর তরমুজ উৎপাদন হয়েছে। করোনার কারণে এই তরমুজ বিপণনে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবুও আমরা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের এসব তরমুজ বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারদের সংযোগ করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি। তবে অসময়ের বৃষ্টিতে বরগুনা, পটুয়াখালী অঞ্চলের তরমুজের কিছুটা ক্ষতি হতে পারে।’