করোনাকালে ভাতা উত্তোলনে যত ভোগান্তি

চলছে বিধবা ভাতা প্রদানের কাজ। আজ দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় সোনালী ব্যাংক কার্যালয়ের পাশে
ছবি: প্রথম আলো

ব্যস্ত সড়কের পাশে নানা বয়সের নারীর ভিড়। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ কেউ মাটিতে দুই পা ছড়িয়ে বসা। আবার কেউ ভবনের বারান্দায় এলিয়ে দিয়েছেন শরীর। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় লকডাউন চললেও সামাজিক দূরত্ব দূরের কথা, অধিকাংশের মুখে নেই মাস্ক।
আজ মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় সোনালী ব্যাংক কার্যালয়ের পাশে এ চিত্র দেখা গেল। ওই নারীদের সবাই বিধবা। তাঁরা ব্যাংক থেকে ভাতা উত্তোলন করতে এসেছেন।

কয়েক শ নারী ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে-দাঁড়িয়ে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় দেওয়া স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনার বালাই নেই এখানে। ভিড়ের মধ্যে চেয়ার–টেবিল নিয়ে বসা এক ব্যক্তি। আর তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে দুই যুবক। তাঁরা এক এক করে নারীদের নাম ডেকে যাচ্ছেন। আর ওই ব্যক্তি টিপসই নিয়ে টাকা নারীদের ধরিয়ে দিচ্ছেন।

কয়েক দিন থেকে অসুস্থ মোড়ল হাট গ্রামের রাবেকা বেগম (৫৪)। এরপরও তাঁকে ভাতা তুলতে আসতে হয়েছে। তিনি বললেন, ‘সেই সকাল থাকি এইঠে বসে আছু। গরমত কষ্ট পাছি। এলা দেড়টা বাজে। ডাক পানুনি।’ এ কথা শুনে বালিয়াডাঙ্গী সমিরউদ্দিন স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শারমিন আকতার (১৯) আক্ষেপ করে বলেন, ডিজিটাল যুগেও ভাতার টাকা তুলতে অসুস্থদের এত কষ্ট করতে হচ্ছে।
কয়েক দিন ধরে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। গরমে কাতর ঘরিয়ালী গ্রামের আকালি রানী (৫৬) বলেন, ‘সকাল ১০টার আগে থেকে এখানে বসে আছি। কখন টাকা পাব ঠিক নাই।’

জিয়াবাড়ি গ্রামের আবেদা বেগম (৫৭) বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ, সরকার এই কয়টা টাকা দেয় বলে একটু রক্ষা পাও। কিন্তু টাকা পাইতে একটা দিন শ্যাষ। এরপর এক শ টাকার ওপরে খরচ হয়ে যাচে।’ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাটিতে পড়ে গেলেন এক নারী। তাঁর মাথায় পানি ঢেলে সুস্থ করে তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সঙ্গীরা। মোড়লহাট গ্রামের আনোয়ারা বেগম (৫৩) বলে উঠলেন, ‘দেখলেন আমাদের অবস্থা। নয় মাস পর ভাতা পাচ্ছি, তা–ও আবার তিন মাসের। এই অবস্থা নতুন না, পেরতেক বারই এই রকম সকাল অইতে বিকাল পর্যন্ত থাকতে হয়।’

চেয়ারে বসা টাকা বিতরণ করা ওই ব্যক্তির কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে কোনো কিছুই বলব না। যা বলার বলবেন ম্যানেজার।’

চেয়ারে বসা টাকা বিতরণ করা ওই ব্যক্তির কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে কোনো কিছুই বলব না। যা বলার বলবেন ম্যানেজার।’ পরে তিনি নিজেকে ব্যাংকের কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম পরিচয় দেন।
বালিয়াডাঙ্গীর জাউনিয়া লাহিড়ি দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক খসিউর রহমান বলেন, ডিজিটাল যুগেও করোনার সময় অ্যানালগ পদ্ধতিতে বিধবা-বয়স্কদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এতে তাঁদের সীমাহীন ভোগান্তির পাশাপাশি করোনায় সংক্রমণের ঝুঁকি থাকছে। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা যেভাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে, বিধবা-বয়স্ক ভাতাসহ যেকোনো ভাতা বিতরণ করলে এসব মানুষের কষ্টটা কমে আসবে।

সোনালী ব্যাংক বালিয়াডাঙ্গী শাখার ব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, ভাতা বিতরণের সময় তাঁদের হিমশিম খেতে হয়। পাশাপাশি সুফলভোগীদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হয়। করোনা পরিস্থিতিতে এভাবে ভাতা বিতরণ করা ঠিক না হলেও উপায় নেই। স্বাস্থ্যবিধির কথা কেউ শুনতে চান না।

বালিয়াডাঙ্গীর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ফিরোজ সরকার বলেন, উপজেলায় ৩ হাজার ৪২৭ জন বিধবা ভাতা পান। বছরে চারটি কিস্তিতে ভাতা দেওয়া হয়। প্রথম কিস্তিতে যাঁরা তুলতে পারেননি, এখন তাঁদেরটা দেওয়া হচ্ছে। একপ্রকার নিরুপায় হয়েই এই করোনাকালে ভাতা বিতরণ করা হচ্ছে। এভাবে ভাতা বিতরণে অসহায় মানুষদের কষ্ট হলেও করার কিছুই নেই। মুঠোফোনের মাধ্যমে কীভাবে টাকা দেওয়া যায়, তা ভাবনায় আছে।

জেলা প্রকাশক কে এম কামরুজ্জামান বলেন, কিছুদিনের মধ্যে বয়স্ক-বিধবাসহ যেকোনো ভাতা প্রদান তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় চলে আসবে। তখন এমন কষ্ট আর থাকবে না।