করোনাকালে স্নাতকে ভর্তিতে ডোপ টেস্টের ‘বোঝা’

স্নাতকে ভর্তি হতে ডোপ টেস্টের নমুনা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে শিক্ষার্থীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বগুড়ার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে
ছবি: সোয়েল রানা

বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের ‘ডোপ টেস্ট’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জনপ্রতি ‘ডোপ টেস্ট’ ফি গুনতে হচ্ছে ৯০০ থেকে দুই হাজার টাকা। করোনাকালে যা অনেক শিক্ষার্থীর জন্যই বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছে। আবার এ টেস্ট ঘিরে শুরু হয়েছে বাণিজ্য।

রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে মাদকের উপস্থিতি আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে ‘ডোপ টেস্ট’ করা হয়। ফল পাল্টাতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ অন্যের রক্ত ও প্রস্রাবের নমুনা দিয়ে প্রতিবেদন সংগ্রহ করে তা কলেজে জমা দিচ্ছেন। কেউ আবার তৈরি করছেন ভুয়া প্রতিবেদন। ডোপ টেস্টের ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি করে দেওয়ার অভিযোগে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। বৃহস্পতিবার রাতে আজিজুল হক কলেজের কামারগাড়ি গেট-সংলগ্ন একটি ফটোস্ট্যাট ও কম্পিউটার কম্পোজের দোকান থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার যুবকের নাম রাসেল মাহমুদ (২৫)। তিনি সরকারি আজিজুল হক কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। তাঁর কাছ থেকে সরকারি হাসপাতালের সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করা ডোপ টেস্টের বেশ কিছু জাল রিপোর্ট জব্দ করা হয়েছে।

পূর্বঘোষণা ছাড়াই কলেজ প্রশাসন হুট করে অনার্স ভর্তিতে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা। এর ফলে করোনার সংক্রমণের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের ছুটতে হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রে। একসঙ্গে বিপুল শিক্ষার্থী ডোপ টেস্টের জন্য হাসপাতাল-রোগনির্ণয় কেন্দ্রে হুমড়ি খেয়ে পড়ায় ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, দেশের অন্য কোনো কলেজে এবং বগুড়ার আর কোনো কলেজে ‘ডোপ টেস্ট’ বাধ্যতামূলক করা না হলেও শুধু সরকারি আজিজুল হক কলেজ প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ওপর এ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। এ পরীক্ষায় তাঁদের মোট ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় অর্ধকোটি টাকা।

এদিকে মাদকের উৎস ও বেচাবিক্রি বন্ধ না করে ‘ডোপ টেস্টে’র নামে শিক্ষার্থীদের ওপর ফির বোঝা চাপিয়ে দেওয়া এবং সামাজিকভাবে হেয় করার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট বগুড়ায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে।

কার নমুনা কে দিয়ে রিপোর্ট সংগ্রহ করছে, সেটা নিশ্চিত করা কঠিন। এভাবে ডোপ টেস্ট না করে শ্রেণিকক্ষেই করা দরকার ছিল।
এ টি এম নুরুজ্জামান, তত্ত্বাবধায়ক, মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল

আজিজুল হক কলেজ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জুন ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ষষ্ঠ সভায় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ‘ডোপ টেস্ট’ বাধ্যতামূলক এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর তা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রিসভার সেই সিদ্ধান্ত অনুসরণের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর তাদের ওয়েবসাইটে গত ২৯ আগস্ট সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চিঠি আপলোড করে। মাউশির উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে কোন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ‘ডোপ টেস্ট’ করানো হবে, এ টেস্টের ফি কত হবে, টেস্টের ব্যবস্থা ও ব্যয় প্রতিষ্ঠান নাকি শিক্ষার্থীরা করবেন, সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা ছিল না।

বগুড়া শহরের সরকারি তিনটি কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ওই চিঠি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছায়নি। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার মাউশির ওয়েবসাইট ঘেঁটেও এমন কোনো চিঠি পাওয়া যায়নি।

কলেজ–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কলেজগুলোতে স্নাতকে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশনা থাকলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানানোর কথা। কিন্তু তারা এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি আজিজুল হক কলেজ প্রশাসন সম্মান শ্রেণিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার আসনে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। শিক্ষার্থী ভর্তিতে ‘ডোপ টেস্ট’ প্রতিবেদন দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে।

‘ডোপ টেস্টে’র নামে শিক্ষার্থীদের ওপর ফির বোঝা চাপিয়ে দেওয়া এবং সামাজিকভাবে হেয় করার সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সমাবেশ
ছবি: প্রথম আলো

এরপর তিন দিন ধরে শিক্ষার্থীরা ডোপ টেস্টের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল এবং বেসরকারি কয়েকটি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে। একেক জায়গায় ‘ডোপ টেস্ট’ ফি আদায় করা হচ্ছে একেক পরিমাণ। এর মধ্যে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৯৫০, মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল ৯০০ এবং বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্র ২ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি আদায় করছে।

গত বুধবার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার ল্যাবরেটরিতে শত শত শিক্ষার্থী ডোপ টেস্টের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা বুথ নেই। একটি মাত্র বুথে রক্ত ও প্রস্রাব সংগ্রহ করছেন দুজন স্বাস্থ্যকর্মী। শিক্ষার্থীদের হুড়োহুড়িতে স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই।

শিক্ষার্থীদের নিরাপদ রাখতেই সরকার দেড় বছর ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখেছে। অথচ কলেজ প্রশাসনের সিদ্ধান্তের কারণে সংক্রমণ ঝুঁকি নিয়েই করোনার হাসপাতালে এসে এভাবে ডোপ টেস্ট করাতে হচ্ছে।
শাহরিয়ার হাসান, শিক্ষার্থী

টেস্ট করতে আসা একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, করোনার কারণে দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর মধ্যে শুরু হয়েছে অনার্সে ভর্তি কার্যক্রম। বিজ্ঞান বিভাগে একজন শিক্ষার্থীকে প্রায় ৩ হাজার এবং কলা ও বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষার্থীদের ২ হাজার ৮০০ টাকা ভর্তি ফি জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর ওপর ডোপ টেস্টের ফি জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। সরকারি দুই হাসপাতালে ফি ৯০০ এবং ৯৫০ টাকা হলেও যাতায়াত এবং দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নমুনা দিতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আছে হাসপাতালে যাতায়াত খরচও।

শাহরিয়ার হাসান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, সরকারি দুটি হাসপাতালেই করোনা ওয়ার্ডে রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ, টিকা প্রদান কার্যক্রমও চালু আছে সেখানে। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ রাখতেই সরকার দেড় বছর ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখেছে। অথচ কলেজ প্রশাসনের সিদ্ধান্তের কারণে সংক্রমণ ঝুঁকি নিয়েই করোনার হাসপাতালে এসে এভাবে ডোপ টেস্ট করাতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী বলেন, এখানে দায়সারাভাবে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। ভর্তির প্রবেশপত্র বা শিক্ষার্থীদের ছবি কিংবা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী শনাক্তের কোনো কিছুই লাগছে না। ফলে মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীরা ডোপ টেস্টের জন্য অন্যজনকে ডেকে এনে নমুনা দিয়ে রিপোর্ট সংগ্রহ করছেন।

মেহেদী হাসান নামের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘করোনার ভয়েই সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে বেসরকারি পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডোপ টেস্ট করেছি। ফি দিতে হয়েছে ২ হাজার টাকা।’

মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এ টি এম নুরুজ্জামান বলেন, গত তিন দিনে হঠাৎ করে ডোপ টেস্টের জন্য শিক্ষার্থীদের ঢল নেমেছে। কার নমুনা কে দিয়ে রিপোর্ট সংগ্রহ করছে, সেটা নিশ্চিত করা কঠিন। এভাবে ডোপ টেস্ট না করে শ্রেণিকক্ষেই করা দরকার ছিল।

শিতাহুল জান্নাত নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘কলেজ প্রশাসনের উদ্ভট সিদ্ধান্তে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল–ক্লিনিকে ইচ্ছেমতো ফি আদায় করা হচ্ছে। ডোপ টেস্ট যদি করতেই হয়, তবে শিক্ষার্থীদের জন্য নামমাত্র ফি নির্ধারণ করা দরকার ছিল।’

সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ শাহজাহান আলী প্রথম আলোকে বলেন, মাউশির সব চিঠিই অনলাইনে ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়। কলেজে আলাদা করে চিঠি আসার কোনো দরকার নেই। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেই অনার্স ভর্তিতে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অন্য কোনো কলেজ অনুসরণ করছে কি না, সেটা তাদের বিষয়।

সরকারি শাহ্ সুলতান কলেজের অধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম বলেন, মাউশির অনলাইনে দেওয়া চিঠিতে ডোপ টেস্ট ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না এমনটা উল্লেখ নেই, সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনাও নেই। করোনার সংক্রমণ এবং অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে ডোপ টেস্টে মাদক গ্রহণ ধরা পড়লে ভর্তি বাতিল হবে, এমন অঙ্গীকারনামা নিয়ে অনার্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে।

সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ জোহরা ওয়াহিদা রহমান বলেন, মাউশির কোনো চিঠি না পাওয়ায় ১ হাজার ১৮০ আসনে ডোপ টেস্ট ছাড়াই ছাত্রী ভর্তি শেষ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন