রাখাইনপল্লির (আছিমং পাড়া) মধ্যভাগে সাজানো একটি প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের এক পাশে জলভর্তি একটি কাঠের নৌকা। নৌকার এক পাশে রাখাইন তরুণীর দল, প্রত্যেকের হাতে পানি ছুড়ে মারার পাত্র। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে কক্সবাজার শহরের পেশকারপাড়া রাখাইনপল্লিতে গিয়ে এ দৃশ্যের দেখা মেলে।
পল্লির রাখাইন তরুণেরা নাচ–গান করে ছুটে আসেন প্যান্ডেলে। এরপর দাঁড়ান নৌকার এক পাশে বসা তরুণীদের সামনে। তরুণদের হাতে থাকে পাত্রভর্তি মঙ্গলজল। পছন্দের তরুণীকে লক্ষ্য করে এ জল ছুড়ে মারেন তরুণ। তরুণীর ইচ্ছা হলে তরুণের ডাকে সাড়া দেন এবং তরুণকে লক্ষ্য করে জল ছুড়ে মারেন। এভাবে প্যান্ডেলে জোড়ায় জোড়ায় চলে তরুণ-তরুণীদের জল ছুড়ে মারার সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব ‘সাংগ্রাং পোয়ে’। বাংলায় যাকে বলে ‘মৈত্রীময় জলকেলি’ উৎসব।
পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নিতে রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ পয়লা বৈশাখ থেকে সাত দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করে থাকেন। এর মধ্যে ১৭ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী চলে ‘সাংগ্রাং পোয়ে’ উৎসব। করোনাভাইরাসমুক্ত পৃথিবীর প্রত্যাশায় আজ সন্ধ্যায় শেষ হচ্ছে রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব।
রাখাইনপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রচণ্ড গরমে ঠান্ডা জলে শরীর ভিজিয়ে আনন্দ–উল্লাস করছেন রাখাইন তরুণ-তরুণীরা। কয়েকটি প্যান্ডেলে শিশু-কিশোরেরাও অংশ নিয়েছে জলকেলিতে। এ জন্য শহরের হাঙরপাড়া, পেশকারপাড়া, বড়বাজার, চাউলবাজার, বৌদ্ধমন্দির সড়কে তৈরি করা হয়েছে ১৭টি প্যান্ডেল। রঙিন ফুল আর নানা কারুকাজে সাজানো হয়েছে প্যান্ডেলের চারপাশ। রাখাইনদের প্রতিটি বাড়িও সেজেছে নতুন সাজে। উৎসবে আসা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার পরনে নতুন কাপড়। সাধারণত প্রতিবছর উৎসবের সময় কালবৈশাখীর ভারী বর্ষণ জলকেলির আমেজ বাড়িয়ে দেয়। তবে এ বছর উৎসবের শেষ দিনেও বৃষ্টির দেখা না পেয়ে কিছুটা হতাশ রাখাইনেরা।
কক্সবাজার সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং বলেন, পঞ্জিকা অনুযায়ী ১৬ এপ্রিল শনিবার রাত ১২টায় ১৩৮৩ রাখাইন অব্দ (মগীসন) শেষ হয়েছে। ১৩৮৪ অব্দ শুরু হয়েছে ১৭ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে। তাই ১৭ এপ্রিল থেকেই সাংগ্রাং উৎসবের আয়োজন করা হয়। আজ সন্ধ্যায় সমাপ্তি ঘটবে এই উৎসবের।
দুপুরে শহরের পেশকারপাড়ার একটি প্যান্ডেলে দেখা যায়, বাইরে কয়েক শ রাখাইন তরুণ–তরুণী নাচ–গানে মেতে উঠেছেন। প্যান্ডেলের এক পাশে দাঁড়িয়ে এক তরুণীর সঙ্গে কথা বলছিলেন আরেক রাখাইন তরুণ। একপর্যায়ে তরুণীর মাথায় মঙ্গলজল ঢেলে দিয়ে সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা করেন তরুণ। তরুণীও হাসিমুখে আগামী বছরের জলকেলিতে দেখাসাক্ষাতের প্রত্যাশা জানান।
কক্সবাজার জেলায় প্রায় ৫০ হাজার রাখাইনের বসবাস বলে জানিয়েছেন রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মংছে হ্লা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর জলকেলি উৎসব হয়নি। তবে ঘরোয়া পরিবেশে কয়েকটি বাড়িতে জলকেলিতে মেতেছিল শিশু–কিশোরেরা। এখন করোনা নিয়ন্ত্রণে, তাই জলকেলি উৎসবও মুখর। এবার শহর ছাড়াও জেলার টেকনাফ, মহেশখালী, রামু, চকরিয়া, হারবাং, চৌফলদণ্ডীর রাখাইনপল্লিতে ৫০টির বেশি প্যান্ডেলে জলকেলি হয়েছে। এ উৎসবের মধ্য দিয়ে রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ করোনামুক্ত অসাম্প্রদায়িক সুন্দর বিশ্ব প্রত্যাশা করেছেন।
কক্সবাজারের সাবেক সাংসদ এথিন রাখাইন বলেন, ‘জলকেলির মধ্য দিয়ে আমরা অতীতের দুঃখ-বেদনা, হিংসা–বিদ্বেষ ভুলে সুন্দরের পথে এগোনোর অঙ্গীকার করেছি। আমরা করোনামুক্ত সমৃদ্ধশালী উন্নত বাংলাদেশ দেখতে চাই।’
১৭ এপ্রিল দুপুরে আছিমং পাড়ায় কেন্দ্রীয় প্যান্ডেলে জলকেলি উৎসবের উদ্বোধন করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) বিভীষণ কান্তি দাশ। কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক মং এ খেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান।