করোনাযোদ্ধা ফারমিছ আক্তারের গল্প

করোনাকালে দুর্ভোগে থাকা মানুষদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন সিলেটের ফারমিছ আক্তার
ছবি: আনিস মাহমুদ

মধ্যবিত্ত পরিবারের এক ব্যক্তি করোনাকালে আয়হীন হয়ে পড়েন। লজ্জায় কারও কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলতেও পারেন না। তাই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন চলছিল তাঁর। পরিচিত একজনের মাধ্যমে পরিবারটির খবর পান এক নারী। তিনি গোপনে ওই ব্যক্তির হাতে এক মাসের খাদ্যসামগ্রী ও নগদ ১৫ হাজার টাকা তুলে দেন।

অতিমারি প্রকোপিত জীবনে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এ রকম কয়েক শ টুকরা গল্পের উদাহরণ দেওয়া যাবে। আর প্রতিটি গল্পেরই কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন নারী। তিনি ফারমিছ আক্তার (৩৮)। বাসা সিলেট নগরের মীরের ময়দান এলাকায়। গত ২৬ মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হলে লোকজন ছিলেন ঘরবন্দী। কাজ হারিয়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণির অনেকে খাদ্যসংকটে ভুগছিলেন। তখন অসহায় মানুষ আর প্রাণীকে ভালোবেসে ফারমিছ দাঁড়ান তাঁদের পাশে।

ফারমিছের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে টানা আড়াই মাস অন্তত ২০ লাখ টাকার খাদ্যসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র তিনি বিতরণ করেছেন সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে। এর বাইরে ৩০টি পরিবারের মধ্যে নগদ ৬২ হাজার টাকাও বিলি করেছেন। কুকুরসহ ক্ষুধার্ত প্রাণীদের খাইয়েছেন। কেউ অসুস্থ হলে যখন পরিবারের সদস্যরা পর্যন্ত পাশে দাঁড়ানোর সাহস পেতেন না, তখন তিনি নিজে ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে ওই অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়েছেন। এসব কাজে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন স্বামী-সন্তানসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে।

করোনাকালে দুর্ভোগে থাকা মানুষের হাত খাবার পৌঁছে দেন ফারমিছ আক্তার
ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেট নগরের শিবগঞ্জ এলাকায় ফারমিছের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তিনি এমসি কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ছোটবেলা থেকেই একজন স্বেচ্ছা সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছেন। ১২ বছর আগে তাঁর বিয়ে হয় নগরের মীরের ময়দান এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী রাফেজ-উল হকের (৪২) সঙ্গে। তিন বছর আগে তিনি রেস্তোরাঁ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। করোনাকালে সেটি বন্ধ করে সেখানে নিজে রান্নাবান্না করে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে খাবার বিলিয়েছেন।

ফারমিছ স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘নগরের উপশহর এলাকার পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারীর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাঁর ছেলে করোনা সন্দেহে মাকে বাসা থেকে বের করে দেন। খবর পেয়ে আমি ওই মাকে হাসপাতালে ভর্তি করি। পরে জানা যায়, তিনি নন-কোভিড। পরে ওই ছেলেকে বুঝিয়ে মাকে পুনরায় ঘরে তুলে দিই।’

সিলেট নগরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ এলাকা, আম্বরখানা, বাগবাড়ি, মেডিকেল, কাজিরবাজার, কিনব্রিজ এলাকা, কুমারপাড়া, মানিকপীর কবরস্থান, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিজের রান্না করা খাবারের প্যাকেট বিতরণ করতেন ফারমিছ আক্তার। প্যাকেটে সাদা ভাতের সঙ্গে একেক দিন একেক তরকারি থাকত।

ফারমিছ বলেন, যুক্তরাজ্য থেকে এক নারী লকডাউনের কয়েক সপ্তাহ আগে সিলেটে এসেছেন। টাকাও শেষ হয়ে যায়। সব ধরনের লেনদেন বন্ধ থাকায় তাঁর সন্তানেরাও টাকা পাঠাতে পারছেন না। এ অবস্থায় তিনি সহায়তা করেন। পরে ওই নারী টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভালো লেগেছে, যখন অনেকে বলেছেন, “আপনার দেখাদেখি আমরাও করোনায় মানবিক কাজ শুরু করেছি।” এটাই তো বড় পাওয়া। সবাই যে মানুষের সহায়তায় নেমেছে, এটাই বড় কথা।’