করোনার দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে 'প্রজন্ম'

বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসহায়দের মধ্যে ঈদের উপহার তুলে দিচ্ছেন প্রজন্মের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসহায়দের মধ্যে ঈদের উপহার তুলে দিচ্ছেন প্রজন্মের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

রাজমিস্ত্রির জোগালী জাহিদুল ইসলাম ধারকর্জ করে বিঘাখানেক জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছিলেন। করোনার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাতে টাকা নেই। শ্রমিকেরও সংকট। টাকার অভাবে সন্তানের গুঁড়া দুধও কিনতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। খবর পেয়ে ছুটে এলেন একদল তরুণ। খেত থেকে ধান কেটে ও মাড়াই করে অসহায় কৃষকের ঘরে তুলে দিলেন তাঁরা। বিদায় নেওয়ার সময় জাহিদুলের হাতে তুলে দিলেন শিশুসন্তানের জন্য দুধ আর কিছু খাদ‍্যসামগ্রী।

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কাজলাপাড়া গ্রামের জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘খ্যাতত পাকা ধান লস্ট হয়্যা যাচ্চিল। হাতত টেকা নাই। ধানকাটার কামলারও অভাব। কুন্টি থ্যাকে চেংড়াগুলো (ছেলেগুলো) খবর পায়্যা বিয়ানবেলা হামার খ্যাতত আসে হাজির। সারা রদিন রোদে পুড়ে ধান কাটে হামার ঘরত তুলে দিয়্যা গেল। চেংড়াগুলো না আসলে ধান খ্যাততই লস্ট হয়্যা যাবার ধরচিল।’

করোনাকালে জাহিদুল ইসলামের মতো বিপাকে পড়া কৃষক, শ্রমিক, দুস্থ মানুষদের বিপদে এভাবেই এগিয়ে এসেছে স্থানীয় তরুণদের নিয়ে গড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্রজন্ম’। শুধু কৃষকের ধান কেটে দেওয়াই নয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু থেকেই তাঁরা নানা মানবিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে। করোনা মোকাবিলায় ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়ে প্রচারপত্র বিলি ও এলাকায় মাইকিং করে মানুষকে স্বাস্থ্যসচেতন করছে। সড়কে যানবাহন থেকে শুরু এলাকার বাজার ও বাড়িতে বাড়িতে জীবাণুনাশক ছিটিয়েছে। বাজারের ১০টি স্থানে এবং ২০টি মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের মধ্যে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়েছে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই)। ঈদে ১০০ অসহায় পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছে উপহার।

খেতের ধান কাটা শেষে কৃষকের বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন প্রজন্মের সদস্যরা। সম্প্রতি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সুখানপুকুর এলাকায়। ছবি: সংগৃহীত
খেতের ধান কাটা শেষে কৃষকের বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন প্রজন্মের সদস্যরা। সম্প্রতি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সুখানপুকুর এলাকায়। ছবি: সংগৃহীত

গাবতলী উপজেলার নেপালতলী ইউনিয়নের সুখানপুকুর এলাকায় প্রজন্ম নামের এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছিল বছর দুয়েক আগে। ঢাকা, রাজশাহী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন কিছু শিক্ষার্থী যুক্ত হন এই সংগঠনে। শুরুটা ছিল মাদকবিরোধী আন্দোলন, জুয়া, বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, গুজব, জঙ্গিবাদ, সাইবার অপরাধ, নারী নির্যাতন, ইভটিজিং প্রতিরোধ ও রক্তদানের মতো সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। সেভাবেই চলছিল সংগঠনের কার্যক্রম। এরপর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় প্রজন্ম নামে অন্য এক লড়াইয়ে।

সংগঠনের সদস্য ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মার্চের শেষদিকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কার্যক্রম শুরু করে প্রজন্ম। সুখানপুকুর বাজারে ১০টি স্থানে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এলাকার ২০টি মসজিদেও একই রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়। সুখানপুকুরের ওপর দিয়ে যাওয়া গাবতলী-সোনাতলা সড়কে চলাচলকারী যানবাহন জীবাণুমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যানবাহনচালকদের মধ্যে বিতরণ করা হয় মাস্ক। সপ্তাহজুড়ে চলে সুখানপুকুর বাজারসহ আশপাশে প্রায় ১৫টি গ্রামে জীবাণুনাশক ছিটানোর কার্যক্রম। যেখানে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা প্রবল, নিয়মিত সেসব জায়গায় জীবাণুনাশক ছিটিয়েছেন তাঁরা।

২১ এপ্রিল থেকে বগুড়া জেলা লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এতে করোনায় কর্মহীন অসহায় মানুষের মধ্যে চলে চাল, ডাল, তেল, আলু ও সাবানের প্যাকেট বিতরণ কার্যক্রম। সরকারি সাহায্য যেখানে পৌঁছায়নি, এমন পরিবার খুঁজে খুঁজে সহায়তা অব্যাহত রাখেন প্রজন্মের স্বেচ্ছাসেবকেরা। সুখানপুকুরের আশপাশের তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) সরবরাহ করেছে প্রজন্ম।

ঈদের দুদিন আগে সুখানপুকুর এলাকার অসহায় বিধবা নারী, প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক, দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া ১০০ পরিবারের কাছে লাচ্ছা সেমাই, চিনি, দুধ, শাড়ি, লুঙ্গিসহ ঈদ–উপহারের প্যাকেট পৌঁছে দিয়েছে প্রজন্ম। নজরার পাড়ার বৃদ্ধ আজিম উদ্দিন (৮৫) বলেন, ‘দুই মাস ধরে ঘরত থ্যাকে বেরোবার পারিচ্চি না। ঘরত খাবার নাই। ঈদত সিমাই কিনবার পারিনি। চেংড়াগুলো বাড়িত আসে হামাক সিমাই, চিনি, দুধ দিয়্যা গেল। আল্লা ওরকেরে ভালো করবি।’

প্রজন্মের সভাপতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সাহানুর ইসলাম বলেন, ‘করোনায় গণসচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, মানবিক সাহায্য করতে গিয়ে অসহায় কৃষকের খেতে পাকা ধান নিয়ে সংকটে থাকার বিষয়টি চোখে পড়ে আমাদের। সঙ্গে সঙ্গে আমরা কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। এই বিপদের সময় অসহায় কিছু কৃষকের পাশে থাকতে পেরে খুব ভালো লাগছে। সহযোগিতা করতে গিয়ে তাঁদের মুখে যে স্বর্গীয় হাসি দেখেছি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’

প্রজন্মের এসব কার্যক্রম চলছে সংগঠনের সদস্য আর স্বেচ্ছাসেবকদের দেওয়া অর্থে। তরুণদের এই মানবিক কর্মযজ্ঞে উৎসাহ দিতে এলাকার শিক্ষিত ও বিত্তবান অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার ব্যবহার করে নিজেদের শতভাগ সুরক্ষা নিশ্চিত করেই বের হওয়ার চেষ্টা করি। এরপরও যদি কিছু হয়ে যায়, এর জন্য আমাদের কাজ থেমে থাকবে না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমরা কাজ করে যাব। পাশে থাকব অসহায় মানুষের।’

প্রজন্মের কর্মযজ্ঞে রীতিমতো আবেগে আপ্লুত সুখানপুকুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম পরিচালক আবদুস সাত্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একঝাঁক শিক্ষার্থী যে কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে এটা অসাধারণ, অতুলনীয়। প্রজন্মের কর্মীরা মানবতার দূত। তাঁরা মানুষকে করোনা থেকে বাঁচাতে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি মানবিক সহযোগিতা নিয়ে অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন।’

প্রজন্মের বিষয়ে গাবতলী-সারিয়াকান্দি সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সাবিনা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রজন্ম আসলে অন্য এলাকার জন্যও রোল মডেল।