করোনায় আয় নেই, ঋণ নিয়ে বিপাকে গ্রাহকেরা

গ্রামে গিয়ে ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আদায় করছেন এনজিওর মাঠকর্মীরা। শরীয়তপুর সদর উপজেলার উপরগাঁও এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

শরীয়তপুর সদরের পালং বাজারে সেলুনের দোকান ছিল কৃষ্ণ শীলের। করোনা ও লকডাউনে সেলুন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে না পেরে মে মাসে দোকানটি বন্ধ করে দেন কৃষ্ণ। দোকানের লোকসান ও পরিবারের খরচ চালিয়ে যেতে তাঁকে এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে কিস্তির মাধ্যমে এটা পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে আবার তাঁকে ঋণ করতে হচ্ছে।

শুধু কৃষ্ণ শীল নয়, এমন পরিস্থিতে পড়েছেন শরীয়তপুরের কয়েক হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। কৃষ্ণ শীল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় দেড় বছর ধরে করোনায় অবরুদ্ধ জীবন পার করছি। কখনো ব্যবসা বন্ধ, কখনো খোলা রেখেছি। খোলা রাখলেও গ্রাহক পেতাম কম। আয় বন্ধ, আয় কম—এমন পরিস্থিতিতে চলতে গিয়ে আশা, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্যুরো বাংলাদেশ নামের এনজিও থেকে স্ত্রীর নামে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। সপ্তাহে ৪ হাজার ৫০ টাকা কিস্তি দিতে হয়। লকডাউনের কারণে কয়েক সপ্তাহ কিস্তি নেওয়া বন্ধ ছিল। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে কিস্তি দিতে হচ্ছে। আয় না থাকায় এখন নিরুপায় হয়ে গেছি।’

শরীয়তপুরে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর সংগঠন ফেডারেশন অব এনজিও ইন বাংলাদেশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি কর্তৃক অনুমোদিত ১৬টি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) শরীয়তপুরে ক্ষুদ্র ঋণের কাজ করে। জেলার ২ লাখ ২৫ হাজার গ্রাহকের মধ্যে এনজিওগুলো ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। বর্তমানে ওই গ্রাহকদের কাছে দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ স্থিতি আছে।

জাজিরা পৌরসভার মতিসাগর এলাকার হাজেরা বেগমের স্বামী স্বপন খান কুয়েতপ্রবাসী। করোনার কারণে এক বছর ধরে দেশে টাকা পাঠাতে পারেন না। ৫ সদস্যের পরিবারের খরচ ও বিভিন্ন খরচ চালাতে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়েছে হাজেরাকে। ছেলের টিউশনির টাকা দিয়ে কয়েক মাস ঋণের কিস্তি চালাতে পারলেও এখন তা বন্ধ।

হাজেরা বেগম বলেন, ‘করোনা আমাদের অনেক অসহায় করে ফেলেছে। এক বছর ধরে স্বামী কোনো টাকা পাঠাতে পারছেন না। সংসারের সব খরচ, পুরাতন ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সাজেদা ফাউন্ডেশন ও ব্যুরো বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। মাসিক কিস্তি ১৭ হাজার টাকা। ছেলে ঢাকার একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তাঁর টিউশনির টাকা দিয়ে কয়েকটা কিস্তি দিয়েছিলাম। এখন ছেলেও ঢাকা থেকে গ্রামে চলে এসেছে, টিউশনি বন্ধ। সংসারে কোনো বিকল্প আয় নেই। সংসারই চালাতে পারছি না, কিস্তির টাকা কীভাবে দেব?’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি এনজিওর নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, করোনায় মানুষ কাজ হারিয়ে সংকটে পড়েছেন। ঋণের কিস্তি দিতে পারছেন না। তাঁদের সঞ্চয় ফেরত দিয়ে, নতুন ঋণ দিয়ে পাশে থাকতে হচ্ছে এনজিওগুলোকে। এনজিওগুলো কর্মীদের বেতন, অফিসভাড়া ও ব্যাংকের সুদ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য সংস্থাগুলোর যে গচ্ছিত সঞ্চয়পত্র রাখা আছে, তা–ও এখন ভাঙতে হচ্ছে। করোনায় মাঠপর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোই এখন সংকটে পড়েছে।

শরীয়তপুরে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর সংগঠন ফেডারেশন অব এনজিও ইন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক শামীম খন্দকার বলেন, করোনার বিধিনিষেধের কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা সংকটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ে ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া আছে। কিন্তু মানুষ সংকটে থাকায় মাঠকর্মীরা গ্রামে যাচ্ছেন, নতুন করে ঋণ দিচ্ছেন। কোথায়ও কিস্তি আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে না বলে তাঁর দাবি।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। সহনশীল অবস্থায় থেকে কিস্তি আদায় করতে হবে। কিস্তি আদায়ের জন্য কোনো মানুষকে চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। চাপ প্রয়োগের অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।