কষ্টের ফসল ভাসছে পানিতে

সিরাজগঞ্জে যমুনা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের ৪ হাজার ৩৬২ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। ফসলের মধ্যে আছে আমন, আগাম সবজি, আখ ও বাদাম।

তিস্তা নদীর স্পার বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলেন পাউবোর শ্রমিকেরা। গতকাল নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ভেন্ডাবাড়ি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

নদীপাড়ে যাঁদের ঘর, তাঁদের বেশির ভাগের কৃষিকাজ নির্ভর করে নদীর পানির ওপর। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের চর কিংবা নদ-নদীতীরবর্তী এলাকায় হেক্টরের পর হেক্টর যেসব জমিতে আমন ধানসহ বিভিন্ন সবজির চাষ হয়েছিল, তা এখন পানিতে ভাসছে। এসব ফসলের চাষ করে যেসব কৃষক জীবিকা নির্বাহ করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন ঘরছাড়া। ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে, নয়তো বিলীন হয়েছে নদ-নদীতে।

প্রথম আলোনিজস্ব প্রতিবেদকপ্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, যমুনা, তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীর পারের নিম্নাঞ্চলের কৃষি ও বাসিন্দাদের দুর্ভোগের চিত্র এখন এমন। এসব নদ–নদীতীরবর্তী বিভিন্ন জেলার পয়েন্টে গতকাল মঙ্গলবারও পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সঙ্গে অব্যাহত আছে ভাঙন।

পানি বৃদ্ধি পেয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করেছে। তলিয়ে গেছে কষ্টের ফসল। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
আফজাল হোসেন, বাসিন্দা, ধুনটের শিমুলবাড়ি গ্রাম

কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় গতকাল পর্যন্ত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে জেলাটিতে। তলিয়ে গেছে প্রায় ১৬ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমির রোপা আমন ও ২৭০ হেক্টর সবজিখেত। ১০০ হেক্টর জমির বীজতলা দীর্ঘদিন পানিতে তলিয়ে থাকায় বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে।

সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু হানিফ জানিয়েছেন, কয়েক দিন ধরে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নিম্নাঞ্চলের ৪ হাজার ৩৬২ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এসব ফসলের মধ্যে আছে রোপা আমন, বোনা আমন, আগাম সবজি, আখ ও বাদাম।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় যমুনার ঢলে তলিয়ে গেছে ১১৫ হেক্টর জমির ফসল। জেলার সবচেয়ে বেশি ২৫৯ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ধুনট উপজেলায়। গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্রবেষ্টিত ফুলছড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়ায় চরাঞ্চলের পাট, পটোল, কাঁচামরিচ ও শাকসবজির খেত তলিয়ে গেছে। তবে কী পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণে কৃষি বিভাগ এখনো জরিপ করেনি।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের গারুহারা গ্রামের জমিলা বেগম বলেন, প্রায় ১০ দিন ধরে তাঁর বাড়ির চারপাশ পানিতে তলিয়ে আছে। নৌকা ছাড়া বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। ঠিকমতো বাজারসদাইও করতে পারছেন না। আমন খেত এত দিন পানিতে তলিয়ে থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে।

বগুড়ার ধুনটের শিমুলবাড়ি গ্রামের আফজাল হোসেন বলেন, বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করেছে। তলিয়ে গেছে কষ্টের ফসল। গবাদিপশু নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

এদিকে পানি বাড়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার স্পার বাঁধে। উপজেলার ঝুনাগাছ চাঁপানী ইউনিয়নের ভেন্ডাবাড়িতে তিস্তা নদীর স্পার বাঁধ গতকাল বেলা তিনটা পর্যন্ত দেড় শ মিটার অংশ ভেঙে গেছে। গত রোববার থেকে এই বাঁধে ভাঙন শুরু হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদদৌলা জানিয়েছেন, ভেঙে যাওয়া ২ নম্বর স্পার বাঁধটির দেড় শ মিটারে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানো হয়েছে।

যমুনার ভাঙনের কারণে এলাকাবাসী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
জালাল উদ্দিন, চেয়ারম্যান, কাজীপুরের নিশ্চিন্তপুর

সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর তীর ভাঙন দেখা দিয়েছে কাজীপুর, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার চরাঞ্চলের কয়েকটি গ্রামে। এরই মধ্যে এ তিন উপজেলার প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি বসতভিটা ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

কাজীপুর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন জানিয়েছেন, যমুনার পানির প্রবল স্রোতে ইউনিয়নের ডিক্রিদোরতা গ্রাম ও জিআরডিপির ৬ নম্বর নৌকাঘাট পয়েন্টে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান শওকত আলী জানিয়েছেন, গত তিন দিনে যমুনার ঢলে তাঁর ইউনিয়নে নোয়ারপাড়া ও দলিকার চর বিলীন হয়েছে। এতে নোয়ারপাড়া চরের ২০০, দলিকার চরের ১৫০, হাটবাড়ি চরের ১০০, কাশিরপাড়া চরের ৬০, শিমুলতাইড় চরের ৫০ এবং মানিকদাইড় চরের ২০ পরিবার আশ্রয়হারা হয়েছে।

বগুড়া জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার ১১ ইউনিয়নের ৬৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী চরাঞ্চলের ১১ হাজার ১১৫ পরিবারের ৪৫ হাজার ২০০ মানুষ। এ পর্যন্ত দুর্গত এলাকায় ১২০ মেট্রিক টন চাল ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।